
প্রকৃতির এক অপার সম্ভাবনাময় লীলাভূমি হাওর। ঋতুচক্রের আবর্তনে হাওরের প্রতিটি রূপই যেন মুগ্ধ করে মানুষকে। বৈশাখে সোনালী ফসলের হাতছানি, সবুজ ধানক্ষেতের ঢেউ, আর গোয়াল ভরা গবাদিপশু ও হাঁসের খামারে হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবন ভরে ওঠে কর্মচাঞ্চল্যে। গ্রীষ্মে পানি শুকিয়ে গেলে ছোট-বড় বিল আর পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয় চারপাশ, আর শীতকালে দূর-দূরান্ত থেকে আসা পরিযায়ী পাখিরা হাওরের বুকে তৈরি করে এক প্রাণবন্ত অভয়াশ্রম। বর্ষায় হাওরের অথৈ জলের মাঝে ছোট ছোট দ্বীপের মতো গ্রামগুলো ভেসে থাকে, বিকেলের মায়াবী সূর্যাস্ত কিংবা সন্ধ্যার স্নিগ্ধ নীল আভা সবকিছু যেন সৃষ্টিকর্তার অকৃপণ হাতের ছোঁয়ায় সাজানো।
হাওরের ভরা পানিতে টর্চলাইটের আলোয় মৎস্য শিকারীদের বিচরণ অথবা চাঁদের আলোর মায়াবী প্রতিচ্ছবি মনকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে তোলে। চাঁদনী রাতে নৌকায় ভেসে বেড়ানো আর ঢেউয়ের দোলায় দুলতে থাকার স্মৃতি সত্যিই ভোলার নয়। তবে, বাতাসের দমকা হাওয়ায় যখন ঢেউ গর্জে ওঠে, প্রকৃতির মোহনীয় রূপ মুহূর্তে বদলে গিয়ে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা দেয়, যা স্বচক্ষে না দেখলে আফসোস থেকে যাবে।
আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে হাওরের অবদান অনস্বীকার্য। বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম এবং রাধারমণের হাত ধরে হাওরের সংগীত পৌঁছেছে এক অনন্য উচ্চতায়। প্রাচীনকালে মসজিদ ও মন্দিরে চরক পূজাসহ নানা লোকায়ত প্রথার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে হাওরের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের স্মৃতিগাথা। উপজেলার মোট উৎপাদিত ধানের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি আসে এই হাওরাঞ্চল থেকে। জামালগঞ্জের পাকনার হাওর তার ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে – "শুকনায় পাও, বর্ষায় নাও" - এই হলো হাওরের বিচিত্র জীবন।
শুকনো মৌসুমে, বিশেষ করে কার্তিকের শেষ দিকে, পাকনার হাওর এক বিস্তীর্ণ সবুজ গালিচায় পরিণত হয়। নিচু জমিতে সবুজ ফসলের হাসি আর উঁচু জায়গায় গাছের সারি এক অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি করে। হাওরের বুকে আঁকাবাঁকা খাল, বিল, ডোবা ছাড়াও বয়ে চলেছে অসংখ্য নদী। বিলগুলো মাছের এক বিশাল অভয়ারণ্য। নদীর দুই পাড়ে বিস্তৃত হিজল-করচের বাগান শীতকালে পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। বর্ষায় পাকনার হাওরের কানাইখালী মরা নদীর দুই পাড়ে মাতারগাঁও, আগারগাঙের পাশে ফেনারবাঁক এবং শান্তিপুরের বাগে হাজার হাজার হিজল-করচ গাছ যেন যেকোনো মানুষের মনকে জুড়িয়ে দেয়। নদীর প্রবাহমান স্রোত না থাকায় কানাইখালী নদী এখন লেকের মতো শান্ত রূপ ধারণ করেছে।
প্রতি বছর শীত মৌসুমে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে থাকে এই বিশাল জলরাশি। চারদিকে সবুজের সমারোহ এবং বিশাল জলরাশিতে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির ভেসে বেড়ানো সকালে ও সন্ধ্যায় এক অপরূপ রূপ ধারণ করে। দূর-দূরান্ত থেকে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন প্রায়শই এই হিজল-করচ বাগানে পিকনিক করতে আসেন।
পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থা সিএনআরএস প্রায় ২০ বছর আগে জামালগঞ্জের পাকনার হাওর এবং শনির হাওরের সরকারি খাস জায়গায় হিজল-করচ গাছ রোপণ করে। এই গাছগুলো এখন হাওরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষের মনে দোলা দিচ্ছে। সিএনআরএস-এর তাহিরপুর কো-অর্ডিনেটর সাইফুল চৌধুরী জানান, তাদের সংস্থা দুই দশক ধরে সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা ও পরিবেশ রক্ষায় জলজ বন উদ্ভাবকের ভূমিকায় কাজ করছে। সুনামগঞ্জ জেলার পাকনার হাওরসহ বিভিন্ন হাওরে প্রায় দশ লক্ষ হিজল-করচ গাছ রোপণ করা হয়েছে, যা বর্তমানে হাওরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষা এবং বিভিন্ন দেশীয় পাখি ও জলজ প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
ঋতুভেদে ভ্রমণের স্থান অনুসন্ধানে আগ্রহী মানুষের জন্য বর্ষাকালে জামালগঞ্জের কয়েকটি স্থান আপনার ভ্রমণ তালিকায় রাখতে পারেন। বিশেষ করে জামালগঞ্জ উপজেলার ফেনারবাঁক ইউনিয়নের মাতারগাঁও, বিনাজুরা, দৌলতপুর, উজানী দৌলতপুর এবং ফেনারবাঁকের কানাইখালী নদীর দুই পাশের হিজল-করচ বাগানগুলো উল্লেখযোগ্য। এসব স্থানে নৌকা ভ্রমণ সম্প্রতি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পাকনার হাওরে ভ্রমণে আপনি এক অদ্ভুত অনুভূতি পাবেন। চারিদিকে সবুজ গাছের ছায়ায় পানির রঙও সবুজাভ হয়ে যেন এক জলরঙের ছবির মতো দেখায়। তবে আসল আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন রাতে, যখন রূপালী চাঁদের আলোয় গাছের মোহনীয় রূপে এক ভিন্ন জগত তৈরি হয়। এখানে আপনি বিভিন্ন প্রজাতির পাখির সন্ধান পেতে পারেন এবং বিশাল হাওরের জেলেদের কাছ থেকে টাটকা মাছ কেনার সুযোগও পাবেন।
এই নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে হলে সুনামগঞ্জ থেকে গাড়িতে অথবা নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ থেকে নৌকা বা স্পিডবোটে জামালগঞ্জ হয়ে ভীমখালী ইউনিয়নের কারেন্টের বাজার থেকে ছোট-বড় অসংখ্য নৌকায় চড়ে হিজল-করচ বাগান ঘুরে আসতে পারবেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুশফিকীন নূর জানান, জামালগঞ্জে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে পাকনার হাওরের হিজল-করচ বাগান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পর্যটকদের সুবিধার্থে এবং পর্যটনকে আরও বিকশিত করতে হাওরে একটি ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হবে। পর্যটকদের যোগাযোগ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় উপজেলা প্রশাসন সব ধরনের সহযোগিতা করবে।
Comments