Image description

ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিলেও এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয়নি। সময়-অসময়ে দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে- এমন কী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হারও বাড়তে থাকে- কোনো কোনো সময় বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। আরো উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে- মৌসুমের পূর্বেই ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়ছে। 

এই বৎসর ডেঙ্গু রোগের ক্ষেত্রে আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, মোট রোগীর প্রায় ৫৭ শতাংশ ঢাকার বাইরের। বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় ২০০০ সালে। ওই বছর এবং তৎপরবর্তী আরও কয়েক বৎসর প্রাণঘাতী রোগটি মূলত রাজধানীতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু রোগটি রাজধানীর পাশাপাশি জেলা ও উপজেলায় ছড়িয়ে পড়েছে; এমনকি ঢাকার তুলনায় জেলা-উপজেলায়ই বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় এই বছরও পরিলক্ষিত হচ্ছে। 

এ বছরও ডেঙ্গু জ্বরে মৃতের সংখ্যা ১০০ ছুঁলো! চলতি মাসেই গত শনিবার পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের। আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় তিন সহস্রাধিক। এ হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। মৃত্যু ও আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা যে এর চেয়ে বেশি, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। প্রতি বছরই এর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে এবং প্রাণহানি ঘটছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এর প্রতিকার কী? 

এ বছর দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছিল আগে থেকেই। কারণ সরকার পরিবর্তনের পর অধিকাংশ সিটি করপোরেশন, পৌরসভার মেয়র-চেয়ারম্যানরা পলাতক বা গ্রেপ্তার হওয়ায় মূলত প্রশাসক দিয়ে চালানো হচ্ছে এগুলো। তারা অনেকে অন্য কাজের অতিরিক্ত হিসেবে এ দায়িত্ব পালন করছেন। তাতে মৌসুমে মশা মারার জরুরি কাজটা সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে না। ওষুধ ছিটানো এবং সচেতনতা সৃষ্টির কাজে তৎপরতার অভাব রয়েছে। 

ব্যক্তি বা সামাজিক পর্যায়েও সচেতনতার ঘাটতি বরাবরের মতোই। কোন মশা কামড়ালে ডেঙ্গুর আশঙ্কা, তারা কোথায় ডিম পাড়ে, কীভাবে বংশ বিস্তার হয়- দীর্ঘদিনের ভোগান্তিতে তা মোটামুটি জনসাধারণের জানা হয়েছে। কিন্তু সচেতনতার অভাব রয়েছে সর্বব্যাপী। আর রয়েছে সামর্থ্যরে সংকট। রাজধানীসহ বিভিন্ন শহর-নগরে অগুনতি ফুটপাত, ঘনবস্তিতে যারা দিনযাপনের গ্লানি বহন করে চলেছে- তাদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ-প্রচেষ্টা কোথায়? এটা তো একা সরকারের পক্ষে কষ্টসাধ্য।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য রাখে ২০০০ সাল থেকে। এরমধ্যে ২০২৩ সালে এ রোগ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যুও হয় ওই বছর। ২০২২ সালে সারাদেশে এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়, যা বাংলাদেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশে মশক নিধন কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ কম। 

ফলে ডেঙ্গু ভাইরাস থেকে নিস্তার পাচ্ছে না মানুষ। বাড়ছে এডিস মশার ঘনত্ব। চলতি বছর আগের তুলনায় বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের হারও। এতে চলতি বছর ডেঙ্গু রোগীর অবস্থা আরও জটিল হওয়ার শঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দ্রুতই কার্যকরী পদক্ষেপ না নিলে আক্রান্তের হার অন্য বছরের তুলনায় বেশি হবে। এবার ঢাকার পাশাপাশি ঢাকার বাইরেও রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের গবেষণা মূলত তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হয়। 

গবেষণা অনুযায়ী মশার ঘনত্ব বেড়েছে। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিনে দিনে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার কেন ঘটছে, তা নির্ণয় করে প্রতিরোধের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। এ বিষয়টি কেউ আমলে নিচ্ছেন না- এরই মধ্যে চোখ রাঙাচ্ছে এডিস মশা। ডেঙ্গুজ্বরের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। এ কারণে প্রতিরোধই এই রোগ থেকে বাঁচার সবচেয়ে বড় উৎকৃষ্ট উপায়। আগে শুধু বর্ষার মৌসুমে বৃষ্টি হওয়ায় ডেঙ্গুর বিস্তার, ঐ নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু এখন যেহেতু বৃষ্টির দিনের সময় বেড়েছে, তাই সারা বছরই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।

ঢাকায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনার কোনো প্রোগ্রাম চোখে পড়েনি। ফলে অযতœ-অবহেলায় এখন ডেঙ্গু সব জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। এখন শুধু জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসনের লোক কাজ করলে হবে না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রত্যেকটি মানুষকে সতর্ক হতে হবে। প্রত্যেকে যার যার ঘর পরিষ্কার রাখলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ হবে। বৃষ্টির সঙ্গে এডিস মশার প্রজননের যোগসূত্র রয়েছে। এবার এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে দুশ্চিন্তার আরও কিছু জায়গা রয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও কার্যকর করা যায়নি। 

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে।  এখনও এ পদক্ষেপ না নিলে ডেঙ্গু মহামারি আকার নেবে তখন করার কিছুই থাকবে না। অন্যদিকে, কিছু কিছু খাল রয়েছে সেগুলো যেন এক একটি মশা তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে। ফলে পরিবেশগত অব্যবস্থাপনার কারণে ডেঙ্গুর সম্মুখীন হচ্ছি আমরা। 

যদি পরিকল্পিত নগরায়ণ, নগরের জলাধার রক্ষা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধতা রোধ, প্রকৃতি রক্ষা, দূষণ রোধের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া যায়; সমন্বিত প্রচেষ্টায় এ মরণব্যাধি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে হবে।  হাসপাতালগুলোর জনবল-প্রযুক্তি, ওষুধপথ্যে সম্পূর্ণ সক্ষমতা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের মূলমন্ত্রই হলো এডিস মশার বিস্তার রোধ। যথাযথ কর্তৃপক্ষের কার্যকর ভূমিকার পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতায় সম্ভব ডেঙ্গু প্রতিরোধ।