Image description

নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম বিআরটিএ’র কতিপয় অসৎ কর্মকর্তা। উপরমহল ম্যানেজ করে দীর্ঘদিন চট্টগ্রামে ঘুষের রাজত্ব কায়েম করেছেন এক সহকারী পরিচালক (এডি)। তিনি গড়ে তুলেছেন ঘুষ বাণিজ্যের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের ফলে চট্টগ্রাম বিআরটিএ অফিসে "নো ঘুষ নো সার্ভিস" সিস্টেম বলবৎ রেখেছে দিনের পর দিন।

সরকার ঘুষের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও রহস্যজনক কারণে এদের লাগাম টানা যাচ্ছেনা বলে একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে। তবে কোন রকমের ঘুষ বা হয়রানি সহ যেকোনো অপরাধের ক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. ফাওজুল কবির খান। যারাই অপরাধে জড়াবে প্রত্যেকইে আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানান তিনি।

সূত্র জানায়, জনরোষে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চট্টগ্রাম বিআরটিএ ছিল একচ্ছত্র ঘুষের হাট। সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর বিভিন্ন দপ্তরে ঘুষের কারবার অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসলেও বিআরটিএ’র সেবায় এর স্পর্শ লাগেনি। নতুন চেয়ারম্যান আসার পর চট্টগ্রাম থেকে ২/১ জনকে বদলি করলেও বহাল তবিয়তে আছেন ঘুষ বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক এক সহকারী পরিচালক (এডি) ও তার সিন্ডিকেট।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআরটিএ’র একাধিক স্টাফ ও ভুক্তভোগী জানান, চট্টগ্রাম বিআরটিএ অফিসে ঘুষ ছাড়া কোন সেবা পাওয়া যায় না। যে কোন কাজের জন্য আগে ঘুষের চুক্তি করতে হয়। চুক্তি হয়ে গেলে খুব সহজেই কাজ হয়ে যায়। আর চুক্তি না হলে দিনের পর দিন ঘুরেও কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যায় না। এসব ঘুষের সিন্ডিকেটে রয়েছেন সহকারী মোটরযান পরিদর্শক আব্দুল মতিন, জেলা রেজিস্ট্রেশন শাখার টিপু সুলতান, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সলিমুল্লাসহ কতিপয় অসৎ কর্মকর্তা।  আর মেট্রো এলাকায় রেজিস্ট্রেশন শাখার ঘুষের ক্যাশিয়ার হিসেবে আছেন রুবেল নামের একজন বহিরাগত লোক।

এই সিন্ডিকেট সেবাপ্রার্থীদের কাছ থেকে ঘুষ ছাড়া কোন কাজ করেন না। আর ঘুষ না দিলে নানাভাবে হয়রানি করেন। এমনকি সব কাগজপত্র থাকলেও ঘুষ না দিলে ফাইল থেকে জরুরি কাগজ বের করে ফেলে দিয়ে গাড়ি মালিকদের বিপদে ফেলে দেন ফলে অনেকে বাধ্য হয়েই ঘুষ দিয়ে থাকেন।

অনুসন্ধানে দেখা যায় ঘুষ আদায় কয়েকটি ধাপে করা হয়। প্রথমত বিআরটিএ’র গ্রাহক সেবা ঠিকমতো দেয়ার জন্য কয়েকটি শাখায় ভাগ করা আছে। এরমধ্যে রুট পারমিট, ফিটনেস, রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্স অন্যতম। এসব প্রত্যেকটা শাখায় নির্ধারিত ঘুষ দিয়ে সেবা পেতে হয় বলে সূত্রের দাবি।

সূত্রটি আরও জানায়, নতুন বাস পারমিটের জন্য ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়, নবায়নের ক্ষেত্রে ৩/৪ হাজার টাকা, আর ঘুষ দিতে না চাইলে মডেল আউট বলে হয়রানি করা হয়। আবার ট্রাকপ্রতি ৩,৪,৫ হাজার, সিএনজির জন্য ১৫শ থেকে ২ হাজার টাকা ঘুষ আদায় করা হয়। 

অন্যদিকে, নতুন রুট তৈরি করতে প্রথমে ২ লাখ টাকা দিতে হয় এডি ও মতিনকে। পারমিটের ঘুষের ভাগ এডি ৬০ শতাংশ আর সহকারী মোটরযান পরিদর্শক মতিন পায় ৪০ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি মাসে ৯৬০ পারমিট দেয়া হয়েছে যার প্রতিটি গড়ে ২হাজার টাকা হিসাব করলে ওই মাসে এই খাতে ঘুষের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২০ লাখ টাকা।

এদিকে, রেজিস্ট্রেশন শাখায় মালিকানা পরিবর্তনের জন্য গাড়ি প্রতি ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। এসব ঘুষের ৫০% এডি, ২০% এলডি, ১৫% এআরও এবং পরিদর্শক ১৫% করে ভাগ পায়।  জেলা এলাকার জন্য টিপু সুলতানের মাধ্যমে আদায় করা হয়। আর মেট্রো এলাকার জন্য প্রত্যেক দপ্তরে আলাদা ক্যাশিয়ার আছে।

অপরদিকে, ফিটনেস প্রদানে সিএনজি ১৫শ থেকে ১৮শ টাকা, ট্রাক ১৮শ থেকে ২ হাজার, হিউম্যান হলার ৪ থেকে ৫ হাজার, ফোরস্ট্রোক থেকে ২৫শ টাকা ঘুষ আদায় করা হয়। ফিটনেস থেকে ১৮% হিসাবে দৈনিক ১৫ থেকে ২০ হাজা টাকা পায় এডি, এছাড়াও নামে বেনামে বিল ভাউচার দিয়ে টাকা আদায় করে আত্মসাৎ করেন তিনি।

নতুন লাইসেন্স ইস্যু করতে কমপক্ষে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা ঘুষের বিনিময়ে চুক্তি করতে হয়। চুক্তি না হলে ফেল করানো হয়। মাসে ১৫ টি বোর্ড বসে, প্রত্যেক বোর্ডে ১৬০ জনের ভাইভা হয় তারমধ্যে১২০/১৩০ জনকে পাশ করানো হয়। যারা পাশ করে প্রত্যেকেই কেননা কোনোভাবে তদবির করে পাশ করতে হয়। প্রতি বোর্ডে ১০/১২ জন সদস্য থাকে তারমধ্যে থেকে এডি একাই ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পায় বাকিগুলো অন্য সবার মাঝে ভাগ হয়ে থাকে। লাইসেন্স খাত থেকে প্রতি মাসে ঘুষ আসে প্রায় ১ কোটি টাকা। এর মধ্যে এডি পায় প্রায় ১৮ লাখ টাকা।

এব্যপারে জানতে চাইলে বিআরটিএ চট্টগ্রাম জেলা সার্কেলের সহকারী পরিচালক (এডি) ঘুষ আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করেন। ১২ বছর চট্টগ্রামে থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ২০১৮ সালে বান্দরবানে বদলি হয়েছিলেন তবে ২০১৯ সালে আবারো চট্টগ্রামে চলে আসেন। সেই থেকে এখনো আছেন।

এ ব্যাপারে বিআরটিএ চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক (ইঞ্জি.) মো. মাসুদ বলেন, এখানে সেবাপ্রার্থীকে হয়রানি বা ঘুষ আদায়ের কোন সুযোগ নাই। তারপরও যদি কেউ এসব অনৈতিক কাজে জড়ায় তবে তদন্তপূর্বক তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।