বিশ্বনাথের চিকিৎসা কেন্দ্রে ডাক্তার ও ওষুধ সংকটে বেহাল দশা

প্রায় আড়াই লক্ষ জনসংখ্যার জন্য একটি মাত্র উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ৫টি সাব সেন্টার, একটি ফ্যামেলি প্লানিং সেন্টার, ও রয়েছে ১৯ টি কমিউনিটি ক্লিনিক। জনসংখ্যার তুলনায় উপজেলার চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল বলে বিশেষজ্ঞদের দাবী। ১ টি পৌরসভা ও উপজেলার ৮ টি ইউনিয়নের মানুষের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য চিকিৎসার মান না বাড়লে স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্ভাবনা কাটবেনা।
উপজেলার স্বাস্থ্যসেবার বর্তমান চিত্র নিয়ে সরজমিনে ঘুরে দেখা গেছে ব্যাপক অনিয়ম, অবহেলা, ওষুধ সংকট, ডাক্তার সংকট, পরিস্কার পরিচ্ছন্নহীতা, সেবা গ্রহীতাদের সেবা না পাওয়া সহ এক মহামারী পরিস্থিতি বিরাজ করছে। স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ওষুধ চুরি করে বিভিন্ন ফার্মেসীতে বিক্রির অভিযোগও রয়েছে। প্রতিটি সাব স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও উপজেলা কমপ্লেক্সে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম এখন নিয়মে দিন পার করছে। হাসপাতাল ও সাব স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিক গুলো নিজেই এখন রোগী সেজে আছে। ডাক্তার নাই, ওষুধ নাই, সৃষ্ট পদের কর্মকর্তা -কর্মচারী, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নকর্মী, গার্ড না থাকায় কমে গেছে সেবাগ্রহীতাদের আগমন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন সুমন এর দেওয়া তথ্যমতে এখানে ৫জন ডাক্তারের পদ থাকলেও আছেন মাত্র ২ জন ডাক্তার। ১ নং লামাকাজী ইউনিয়নের দীঘলী সাব স্বাস্থ্য কেন্দ্র, বিশ্বনাথ সদর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও দশঘর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র, অলংকার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কোনো ডাক্তারই নাই। এই কেন্দ্রেগুলোতে শুধু আছেন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা ও মিড ওয়াইফ পোস্টে কোনোটিতে একজন কোনোটিতে ২ জন চিকিৎসক। এসব স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রতিদিন গড়ে ১০ থেকে ১৫-২০ জন রোগীর আগমন ঘটে। গেল বছর শতশত রোগীর আগমন ছিল। ঔষধ ও ডাক্তার না থাকায় খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে রোগীদের।
বিশ্বনাথ সদর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ( FWV) নিলিমা রাণী দাসের সাথে কথা হলে তিনি জানান এই কেন্দ্রে ৩ বছর যাবৎ কেন্দ্র ইনচার্জ বা ডাক্তারই নাই। খাতাপত্র ঘেটে দেখা গেছে দৈনিক গড়ে ২ জনের বেশি কোনো রোগীই এখানে আসেন না। রোগী না আসার কারণ জানান তিনি, মানুষ ওষুধ পায় না, কেন্দ্রে কোনো ওষুধ নাই। তবে বছর দেড়েক আগে প্রচুর রোগী আসতো। কেন্দ্রের বিভিন্ন কক্ষের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ আর এলোমেলো আসবাবপত্র, ময়লা আবর্জনা দেখলে বুঝা যায় কেন্দ্রটি নিজেই রোগী হয়ে আছে।
১ নং লামাকাজী ইউনিয়ন পরিষদের দিঘলী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে যা জানা গেছে,তাতে চোখ কপালে উঠার মত। ১ বছরে তিন বার চুরি হয়েছে কেন্দ্রটি। গত বছর ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী চুরির ঘটনা গুলো ঘটে। থানা পুলিশকে অবগত করা হলেও কোন চোর ধরা পড়ে না, মালামাল ও উদ্ধার হয়নি। কেন্দ্রে মোট ৪টি পোস্ট রয়েছে। একজন উপসহকারী চিকিৎসক ও একজন মিডওয়াইফ চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন ।
এই কেন্দ্রটি উপজেলার উত্তর সীমান্ত ঘেষা হওয়ার কারণে প্রশাসনের জোর নজরদারি থাকেনা বিধায় সব সময় কর্মরত ডাক্তাররা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এমটি জানান কেন্দ্রের একজন উপসহকারী চিকিৎসক মোঃ আকিজ উদ্দিন। তিনি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে নিরাপত্তা প্রহরী, পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগের ব্যবস্থা করতে এবং কেন্দ্রটি সিসিটিভির আওতায় আনতে দাবী জানান।
উপসহাকরী আকিজ উদ্দিন জানান, প্রায় ১০ মাস ধরে ওষুধ স্বল্পতার কারনে রোগীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আমি ২ বছর ধরে এই কেন্দ্রে আছি। আগে রোগীর চাপ সামলানো যেত না কিন্তু এখন যারা আসে তাদের ওষুধ দিতে পারি না। এজন্য রোগীর চাপ কমছে।
লামাকাজী ইউনিয়নের ভুরকী বাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ৫ জন কর্মকর্তার বদলে আছেন ৩ জন মাত্র। এই কেন্দ্রের পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক এ কে এম শামসুজ্জামান মিলন জানান ওষুধের স্বল্পতার কারনে রোগীর সংখ্যা কমে গেছে। এখন তারা বসে বসে গল্পগুজব করে সময় পার করেন। এসময় ৫ জন সহকারী স্বাস্থ্যকর্মী মিলে গল্প করতে দেখা যায়। পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাগণ বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেবা ও জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতনতার পরামর্শ দিবেন, তা না করে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে সময় পার করছেন কেন এমন এক প্রশ্নের উত্তরে তারা জানান, শুধু কনডম ছাড়া আর কোন সরকারি ওষুধের উপকরণ না থাকায় মাঠে কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন তারা।
উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কথা হয় সেবা গ্রহীতা রাগীব আলী, আব্দুল করিম, নিছমা বেগম ও জয়নব বিবির সাথে, তারা জানান ওষুধ নাই, ডাক্তার নাই। রাগীব আলী বলেন, আমি ডায়াবেটিস সহ একাধিক রোগের রোগী কিন্তু কিছু ওষুধ পাই, বাকী গুলো বাহির থেকে কিনে নিতে বলেছে।
বিশ্বনাথ উপজেলা সহকারী পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ননী গোপাল সরকারের তথ্য মতে উপজেলা জুড়ে পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ৪২ জনের (এফডাব্লিউএ) পদ থাকলেও কর্মরত আছেন ৩০ জন। লামাকাজী ইউনিয়নে ৫ জন, খাজাঞ্চি ইউনিয়নে ৫ জন, অলংকারী ইউনিয়নে ৪ জন, রামপাশা ইউনিয়নে ৪ জন, দৌলতপুর ইউনিয়নে ৫ জন, দেওকলস ইউনিয়নে ৩ জন ও দশঘর ইউনিয়নে ২ জন রয়েছে। ওষুধের উপকরণ সংকটের কথা স্বীকার করেন তিনি।
বিশ্বনাথ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ দেলোয়ার হোসেন সুমন জানান, ৫০ শয্যার উপজেলা হাসপাতালটিতে দৈনিক ৩ শত থেকে ৪শত রোগী ইনডোর ও আউটডোর বিভাগে সেবা নিতে আসে, কিন্তু জনবল সংকটে সেবা প্রদান ব্যহত হচ্ছে। ওষুধ স্বল্পতা রয়েছে, এ্যাম্বুলেন্স চালকের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। জনবল নিয়োগ না দিলে অচলাবস্থা দুর হবে না।
Comments