Image description

কক্সবাজারের বাঁকখালী নদী উদ্ধার করতে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়েছে। আজ সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টা থেকে এই অভিযান শুরু হয়। দখলমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তারা।

কক্সবাজার শহরের পশ্চিম পাশে অবস্থিত বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট একসময় ছিল প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এই ঘাট ব্যবহার করে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত চলত জাহাজ ও যাত্রীবাহী লঞ্চ। বর্তমানে এসবই কেবল স্মৃতি।

এখানে প্রায় ৩০০ একরের বেশি প্যারাবন ধ্বংস করে ও নদী ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে দুই শতাধিক পাকা-সেমিপাকা ঘরবাড়ি, দোকানপাটসহ নানা স্থাপনা। শুধু কস্তুরাঘাট নয়, নুনিয়াছাটা থেকে মাঝিরঘাট পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বাঁকখালী নদী দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে সহস্রাধিক অবৈধ স্থাপনা।

এই পরিস্থিতিতে আজ সোমবার বাঁকখালী নদীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান শুরু করে সরকার। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএ যৌথভাবে এই অভিযান পরিচালনা করছে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. খায়রুজ্জামান বলেন, "বাঁকখালী নদী দখলমুক্ত করে নদীর স্বাভাবিক গতি-প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে আজ থেকে অভিযান শুরু হয়েছে। সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত এ অভিযান চলবে।"

তিনি আরও জানান, অভিযান চলাকালে যেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে, সেজন্য পুলিশ, কোস্ট গার্ড, সেনাবাহিনী ও র‍্যাব মোতায়েন রয়েছে।

জানা গেছে, বাঁকখালী নদীর দখলদারদের তালিকা করেছে স্থানীয় ভূমি অফিস ও বিআইডব্লিউটিএ। সহস্রাধিক দখলদার থাকলেও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন প্রায় সাড়ে ৩০০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি। এর মধ্যে রয়েছেন, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম, কক্সবাজার পৌর বিএনপির সভাপতি রফিকুল হুদা চৌধুরী ও এবি পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা জাহাঙ্গীর কাশেম।

উল্লেখ্য, উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ও ১ মার্চ যৌথ অভিযানে চার শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। তখন ৩০০ একরের বেশি প্যারাবনের জমি দখলমুক্ত করা হয়েছিল।

তবে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উচ্ছেদ করা সেই প্যারাভূমিতে আবারো গড়ে উঠেছে দুই শতাধিক ঘরবাড়ি ও দোকানপাট। অনেকেই টিনের বেড়া দিয়ে জলাভূমি ঘিরে রেখেছেন। কস্তুরাঘাট থেকে সেতুর দিকে যাওয়ার সড়কের পাশে বিশাল বর্জ্যের স্তূপ দেখা গেছে, যেখানে ট্রাকে করে শহরের ময়লা ফেলা হচ্ছে। পরে খননযন্ত্র দিয়ে সেই বর্জ্য নিচু এলাকায় ফেলা হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশকর্মীরা জানিয়েছেন, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মাত্র ৪৫ দিনের মধ্যে উচ্ছেদ হওয়া এলাকাগুলোতে ফের দখল ও নির্মাণের হিড়িক পড়ে। এ পর্যন্ত কেউ বাধা দেয়নি।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, “গত শনিবার কক্সবাজার সার্কিট হাউসে হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়নে একটি সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নৌপরিবহন উপদেষ্টা ড. এম সাখাওয়াত হোসেন উপস্থিত ছিলেন। নদী রক্ষায় সিদ্ধান্ত হয়েছে—সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে নদীর সীমানা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে।”

এদিকে, গত ২৪ আগস্ট হাইকোর্ট বাঁকখালী নদীর দখলদারদের তালিকা প্রস্তুত করে আগামী চার মাসের মধ্যে উচ্ছেদ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে আগামী ছয় মাসের মধ্যে নদীটিকে “প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ECA)” হিসেবে ঘোষণা দিতে এবং সে মোতাবেক ব্যবস্থাপনা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, বাঁকখালী নদীর বর্তমান প্রবাহ ও আরএস জরিপ অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণ করে সংরক্ষণ করতে হবে। এছাড়া, পূর্বে প্রদত্ত রুল চূড়ান্তকরণের মাধ্যমে নদী ও নদীসংলগ্ন এলাকাগুলো অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ইজারা প্রদান বন্ধ করতে হবে, পূর্বে দেওয়া সব ইজারা বাতিল করতে হবে, নদী এলাকার ম্যানগ্রোভ বন পুনরুদ্ধার করতে হবে।

রায় অনুযায়ী, মামলাটিকে চলমান মামলা হিসেবে গণ্য করে প্রতি ৬ মাস পর পর, অর্থাৎ জানুয়ারি ও জুলাই মাসে, সংশ্লিষ্ট নির্দেশনার বাস্তবায়ন প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে হবে।

এই রায় এসেছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) দায়ের করা একটি মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষে। বিচারপতি কাজী জিনাত হক ও বিচারপতি আইনুন নাহার সিদ্দিকার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় প্রদান করেন।