Image description

যশোরের কেশবপুরে টানা বর্ষণ ও নদ-নদীর পানি উপচে পড়ায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন হাজারো মানুষ। পৌরসভা ও আশপাশের গ্রামগুলোর ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। হরিহর নদ বিপৎসীমার দুই ফুট ওপরে প্রবাহিত হওয়ায় পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পানিবন্দী মানুষ শেষ পর্যন্ত যশোর-চুকনগর সড়কের পাশে ত্রিপল ও বাঁশের তৈরি টংঘরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন।

রাস্তার ধারে অস্থায়ী গ্রাম
পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যকুল আমতলা এলাকায় যশোর-চুকনগর সড়কের ধারে বাঁশ ও ত্রিপল দিয়ে অস্থায়ী টংঘরে বসবাস করছেন বহু পরিবার। মধ্যকুল সরদারপাড়ার হামিদা খাতুন (৪০) জানান, “এক মাস ধরে ঘরে পানি। গত সপ্তাহে টানা বৃষ্টিতে হাঁটুসমান পানি ঢুকে যায়। ছোট বাচ্চাদের নিয়ে কাদামাটির মধ্যে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ায় রাস্তায় উঠে এসেছি।”

পাশেই ভ্যানচালক জিন্নাত আলী বলেন, “আমরা গরিব মানুষ, ভিটে ছেড়ে কোথায় যাব? তাই রাস্তার ধারে টংঘরই এখন ভরসা।”

যাতায়াতে দুর্ভোগ, জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত
পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাহাপাড়া খ্রিষ্টান মিশন এলাকার রাস্তা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বাঁশের সাঁকো দিয়ে চলাচল করছেন স্থানীয়রা। বয়স্ক ও অসুস্থদের জন্য এটি মারাত্মক কষ্টকর।

কেশবপুর সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রভাষক আলাউদ্দীন জানান, তাঁর ইউনিয়নের ১১টি গ্রামের অধিকাংশ পানিতে তলিয়ে গেছে এবং জলাবদ্ধ পরিবারের সংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়েছে। আলতাপোল এলাকার ১১টি পরিবার একটি উঁচু ঘরে আশ্রয় নিয়েছে।

জলাবদ্ধতার কারণ ও সমাধানের দাবি
২৭ বিল বাঁচাও আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক বাবর আলী গোলদার বলেন, “নদ-নদীতে পলি জমা ও অপরিকল্পিত মাছের ঘেরের কারণে পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হচ্ছে। নদ-নদী খনন ও টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) চালু না হলে এ সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হবে।”

সাবেক পৌর কাউন্সিলর আয়ুব খান জানান, “মানুষ শুধু ত্রাণ নয়, জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান চায়। বছরের পর বছর এ সমস্যায় কৃষি ও মৎস্য খাতের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।”

পরিসংখ্যানে ভয়াবহতা
পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল ফজল মো. এনামুল হক জানান, পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডেই জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে এবং জলাবদ্ধ পরিবারের সংখ্যা ৩,২০০ ছাড়িয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সুমন শিকদার বলেন, “হরিহর নদে পানি এখন ১০.৭৬ ফুট, যেখানে স্বাভাবিক মাত্রা ৮.৬৯ ফুট। হরিহর, আপারভদ্রা ও হরিনদীসহ ১০টি সংযোগ খাল পুনঃখননের প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। আগামী জানুয়ারিতে কাজ শুরু হতে পারে।”

মানবিক বিপর্যয় ও জীবনযুদ্ধ
পানিবন্দী মানুষেরা পেশা হারাচ্ছেন, ধান রোপণ করতে পারছেন না, মাছের ঘেরের ক্ষতিতে ঋণের বোঝা বাড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে ডুবে শিশুদের পড়াশোনা বন্ধ। টংঘরে বসবাসকারী পরিবারগুলো স্বাস্থ্যসুবিধা থেকে বঞ্চিত। ত্রিপলের ঘরে গরমে শিশুরা হাঁসফাঁস করছে, বৃষ্টিতে বিছানা ভিজছে। খাবারের অভাবের পাশাপাশি পানিবাহিত রোগের আশঙ্কাও বাড়ছে।

স্থায়ী সমাধানের দাবি
স্থানীয় উন্নয়নকর্মী ও পরিবেশবিদরা বলছেন, জলাবদ্ধতা সমাধানে স্বল্পমেয়াদি ত্রাণের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামোগত পদক্ষেপ জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে নদ-নদী ও খাল খনন, টিআরএম কার্যক্রম, অপরিকল্পিত মাছের ঘের উচ্ছেদ, প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ পুনঃস্থাপন ও উঁচু আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ। হামিদা খাতুন বলেন, “আমরা দান চাই না, চাই এমন ব্যবস্থা যাতে ঘরে থাকতে পারি।” এই দাবি কেশবপুরের হাজারো পানিবন্দী মানুষের।