চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ৪১ বছর শিক্ষকতা শেষে রাজকীয় বিদায়

দীর্ঘ ৪১ বছর চাকরি জীবনের পর ইবতেদায়ীর সহকারি শিক্ষক হাফেজ মাওলানা কাজী মো. আবুল কালামকে ফুলেল শুভেচ্ছা ও বিদায়ী সংবর্ধনা দেয়ার পর ঘোড়ার গাড়িতে করে পুরো এলাকা ঘুরিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এ শিক্ষক চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বখতিয়ারপাড়া চারপীর আউলিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ইবতেদায়ীর সহকারী শিক্ষক ছিলেন।
সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) সকাল দশটায় উপজেলার বখতিয়ারপাড়া এলাকার মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে ব্যতিক্রমী আয়োজন করেন মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। ফুলসজ্জিত ঘোড়ার গাড়ি। সড়কের দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে ফুল হাতে ছাত্রছাত্রীরা। গাড়িতে বসে আছেন বিদায়ী শিক্ষক। সামনে-পেছনে শত শত মোটরসাইকেল শোভযাত্রায় শিক্ষার্থীরা।
অবসর বেলায় এমন আয়োজনে আবেগাপ্পুত হয়ে পড়েন ওই শিক্ষক। এসময় বিদায়ী শিক্ষককে সম্মাননাও প্রদান করা হয়। এদিন সকাল থেকে মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে চলে বিদায় সংবর্ধনা ও আলোচনা সভা। অধ্যক্ষ কাজী মো. আবদুল হান্নানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ফেরদৌস হোসেন, প্রধান আলোচক গভর্নিং বডির সভাপতি মাওলানা মোহাম্মদ ওসমান গণি। অনুষ্ঠানে স্থানীয় নুর মোহাম্মাদ, হাজী মো. ইউনুছ, লুৎফর এনাম চৌধুরী, আবু সৈয়দ সওদাগর, নুর মুহাম্মদ, বশির রিফাতসহ গণমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
এসময় বক্তারা স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘শিক্ষক হাফেজ মাওলানা কাজী মো. আবুল কালাম চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সহকারী শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে গিয়ে গড়ে তুলেছেন ভালোবাসা ও আন্তরিকতার অনন্য বন্ধন। বিদায়ের দিনে প্রাক্তন শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে নানা শ্রেণিপেশার মানুষও ভিড় জমায় তাঁর শেষ মুহুর্তের সাক্ষী হতে। কাজী মো. আবুল কালামের মতো নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক সমাজে বিরল। তিনি সততা, নিষ্ঠা ও দায়িত্ববোধের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তাঁর শিক্ষা ও কর্মপদ্ধতি নতুন প্রজন্মের জন্য দিকনির্দেশনা হয়ে থাকবে। তিনি বিদায় নিলেও তাঁর শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন।’
বিদায়ী শিক্ষক হাফেজ মাওলানা কাজী মো. আবুল কালাম বলেন, ‘কখনো কল্পনা করতে পারিনি এত সম্মান ও বর্ণাঢ্য আয়োজনে এভাবে আমাকে বিদায় দেয়া হবে। সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের ভালোবাসায় আমি ধন্য। সেইসঙ্গে আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন। আমিও সবার জন্য দোয়া করবো।’
প্রাক্তন ছাত্র জানে আলম বাদশা বলেন, হুজুর অত্যন্ত ভালো মানুষ, তিনি আমাদের বাবার মতো সবসময় আদরও মমতা দিয়ে পড়াতেন। আজ হুজুরের বিদায় হলো, আমরা হুজুরের দীর্ঘায়ু কামনা করি।
অধ্যক্ষ কাজী মো. আবদুল হান্নান বলেন, ‘আমরা একজন ভালো সহকর্মীকে বিদায় দিলাম আজ। তিনি আমাদেরকে সব সময় ভালো বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সকলের সঙ্গে তিনি সবসময় ভালো আচরণ করতেন। সবসময় আন্তরিকতার সহিত শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতেন। তার এই শূন্যতা জানিনা পূরণ হবে কিনা। আমরা চেয়েছি তাঁর বিদায়টা যেন সম্মানজনক হয়। অনেক সময় দেখা যায়, শিক্ষককে বিদায় দিতে শুধু একটি ছাতা বা কাপড় দেওয়া হয়-যা দৃষ্টিকটু ও অসম্মানজনক। তাই আমরা ব্যতিক্রম কিছু করার চেষ্টা করেছি। আমরা দোয়া করি তিনি সবসময় ভালো থাকুক।’
আনোয়ারা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ফেরদৌস হোসেন বলেন, ‘একজন শিক্ষক যখন তাঁর চাকরিজীবন শেষ করে বিদায় নেন, এটা তাঁর জন্য কষ্টের। তখন বিদায় মুহুর্তে এমন রাজকীয় বিদায় তাঁকে সম্মানিত ও আনন্দিত করে। আজকের এমন আয়োজন সত্যি খুবই প্রশংসনীয়।’
অনুষ্ঠানের শেষপর্বে ফুলে সজ্জিত ঘোড়ার গাড়িতে করে তাঁকে বিদায় দেওয়া হয়। ফুলে-ফুলে সিক্ত হয়ে আবেগঘন মুহুর্তে শিক্ষার্থীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এই প্রবীণ শিক্ষক। এসময় মাদ্রাসার শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
Comments