
গাজা উপত্যকা আজ এক জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড। আকাশ থেকে ঝরে পড়া বোমার আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হচ্ছে ঘরবাড়ি, ধূলিসাৎ হচ্ছে মানুষের স্বপ্ন। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে পোড়া মাংস আর ধ্বংসস্তূপের চাপা গন্ধ, সেই সঙ্গে মিশে আছে অসহায় মানুষের আর্তনাদ। প্রতিদিন এখানে রচিত হচ্ছে মানবতার চরম অবমাননার নতুন নতুন চিত্র। নিষ্পাপ শিশুরা, অসহায় মায়েরা, জীবন সায়াহ্নে উপনীত বৃদ্ধরা, কেউ রক্ষা পাচ্ছে না এই ধ্বংসলীলা থেকে।
এই রক্তক্ষয়ী সংঘাত মানব ইতিহাসের পাতায় আরও একটি কালো অধ্যায়ের জন্ম দিচ্ছে। অথচ, এই ভয়াবহ বাস্তবতার সামনেও তথাকথিত বিশ্বনেতাদের সিংহভাগ আশ্চর্যজনকভাবে নীরব, নিষ্ক্রিয় এবং তাদের দায়িত্ব পালনে চরমভাবে ব্যর্থ। প্রশ্ন জাগে, মানবতা আজ কোথায়? বিশ্ব বিবেক কি সত্যিই বধির হয়ে গেছে?
ইসরায়েলি আগ্রাসনের নির্মম শিকার হচ্ছে হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এমনকি সাংবাদিকদের দপ্তরও। আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করে এসব সুরক্ষিত স্থান পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে যেখানে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী বেসামরিক স্থাপনা এবং ব্যক্তিরা সুরক্ষিত থাকার কথা, সেখানে প্রতিনিয়ত চালানো হচ্ছে নির্বিচার বোমা বর্ষণ। গাজা আজ মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে, যেখানে দিগন্তজুড়ে কেবল সারি সারি নিথর দেহ।
খাদ্য, জল, বিদ্যুৎ এবং চিকিৎসার অভাবে সেখানকার মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বেঁচে থাকার ন্যূনতম উপকরণটুকুও আজ তাদের কাছে সোনার হরিণ। এমন এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতেও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কার্যত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো দায়সারা গোছের কিছু বিবৃতি দিয়েই যেন তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। উল্টো তাদের কেউ কেউ আবার সামরিক সহায়তা প্রদান করে এই আগ্রাসনকে আরও উস্কে দিচ্ছে।
মুসলিম বিশ্বও আজ ঐক্যহীন, বিচ্ছিন্নভাবে কিছু প্রতিবাদ জানাচ্ছে বটে, কিন্তু তা এই ভয়াবহ পরিস্থিতি পরিবর্তনে কোনো বাস্তব প্রভাব ফেলতে পারছে না। মানবাধিকার, ন্যায়বিচার আর শান্তির বাগাড়ম্বর করা বিশ্বশক্তিগুলো গাজার এই অমানবিক দৃশ্য দেখেও নির্বিকার থাকছে, যা সত্যিই হতাশাজনক। এই নীরবতা প্রকারান্তরে আগ্রাসনকারীদের আরও দুঃসাহসী করে তুলছে। এই নীরবতা এক ভয়ংকর বার্তা বহন করে। এটি কেবল গাজার অসহায় মানুষদের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা নয়, বরং মানবতার মৌলিক নীতির প্রতিও চরম অবজ্ঞা।
আজ যদি গাজার শিশুদের কান্না চিরতরে থেমে যায়, তবে মনে রাখতে হবে, আগামীতে অন্য কোনো ভূখণ্ডেও একই বীভৎস দৃশ্য দেখা যেতে পারে। যদি রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়, তবে এই তথাকথিত সভ্যতা কতটা নিরাপদ? বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারের ধ্বজাধারীরা আজ কোথায়? কেন তাদের কণ্ঠ গাজার নিরীহ মানুষের আর্তনাদে মুখর হচ্ছে না?
এই সংকটময় পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমের ভ‚মিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যখন পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে সত্যকে আড়াল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে, তখন সাধারণ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে সত্য তুলে ধরার এক অসম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা কি যথেষ্ট? বিশ্ব মঞ্চে কি তা কোনো জোরালো প্রভাব ফেলতে পারবে? কর্পোরেট মিডিয়ার বাইরে গিয়ে সাধারণ মানুষের তোলা ছবি ও ভিডিওগুলো হয়তো কিছুটা হলেও বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিতে সক্ষম হচ্ছে, কিন্তু তা স্থায়ী ও কার্যকর সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়।
গাজার এই মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি আমাদের গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করে, আমরা কি কেবল অসহায় দর্শক হয়ে এই ধ্বংসলীলা দেখব? নাকি সম্মিলিতভাবে মানবতার পক্ষে, প্রতিটি নিরীহ প্রাণের পক্ষে সোচ্চার হব? ইতিহাস সাক্ষী, নীরবতা কখনোই কোনো গণহত্যা, কোনো আগ্রাসন থামাতে পারেনি। বরং নীরবতা অপরাধীকে আরও উৎসাহিত করে। আজ প্রয়োজন বিশ্বজুড়ে সম্মিলিত কণ্ঠস্বর, কার্যকর কূটনৈতিক চাপ এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গাজার মানুষের জন্য মানবিক সহায়তা। অবিলম্বে এই রক্তপাত বন্ধের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
গাজার মানুষ এখনো তাদের জীবন বাঁচানোর জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছে। তাদের শিশুদের চোখে এখনো বেঁচে থাকার স্বপ্ন। আমরা কি তাদের পাশে দাঁড়াবো, তাদের আর্তনাদ শুনবো? নাকি ইতিহাসের পাতায় আরেকটি কলঙ্ক লেখা হতে দেখে কেবল মাথা নিচু করে বসে থাকব? আমাদের নীরবতা যেন আর কোনো মায়ের বুক খালি না করে, আর কোনো শিশুর স্বপ্ন কেড়ে না নেয়, এটাই হোক আজকের বিশ্ব বিবেকের প্রধান অঙ্গীকার। প্রতিটি বিবেকবান মানুষের উচিত গাজার পক্ষে আওয়াজ তোলা এবং এই অমানবিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।
লেখক: শিক্ষার্থী
Comments