Image description

আগামী ১ আগস্ট ২০২৫ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানির ওপর ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ফলে দেশের অন্তত ২৫০টি পোশাক কারখানা মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়তে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। এই কারখানাগুলোর রপ্তানির ৬০ থেকে ১০০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ওপর নির্ভরশীল, ফলে এই শুল্ক বাস্তবায়িত হলে তাদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। এছাড়া, মার্কিন বাজারের ওপর কম নির্ভরশীল আরও ১ হাজার কারখানাও উল্লেখযোগ্য চাপের মুখে পড়তে পারে।

বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও অনন্ত গার্মেন্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইনামুল হক খান বাবলু গণমাধ্যমকে বলেন, "যেসব রপ্তানিকারক তাদের মোট রপ্তানির ৬০ শতাংশের বেশি যুক্তরাষ্ট্রে করে, তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বেন।"

তিনি বলেন, "ইতোমধ্যে ১০ শতাংশ বাড়তি শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা অনেক কারখানাকে ২ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত ট্যারিফ বহন করতে হয়েছে। এতে তারা ইতোমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত। এর সঙ্গে যদি আরও ৩৫ শতাংশ যুক্ত হয়, তাহলে এসব কারখানার জন্য দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। শুধু রপ্তানিকারকরাই নন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারাও এ নিয়ে উদ্বিগ্ন।

একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার, যেখানে বছরে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু জানিয়েছেন, বর্তমানে সংগঠনটির প্রায় ২ হাজার ৫০০ পোশাক কারখানা বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানি করে।

বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে ১ হাজার ৩২২টি কারখানা যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে। এছাড়া, অপর সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)-এরও কিছু সদস্য কারখানা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানি করে থাকে। তবে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা জানাতে পারেননি।

তবে একাধিক সূত্র জানায়, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ'র কমন সদস্য বাদ দিয়ে প্রায় ২০০ কারখানা যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে, যার মধ্যে প্রায় ৫০টি কারখানার রপ্তানির ৬০ শতাংশের বেশি হয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। এই হিসেবে উভয় সংগঠনের অন্তত ৩০০টির বেশি কারখানা উচ্চমাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর হওয়ায় বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারে।

৩৫ শতাংশ শুল্ক চাপ অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবচেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানি করে হা-মীম গ্রুপ। এই প্রতিষ্ঠানের রপ্তানির বড় অংশই মার্কিন বাজারনির্ভর। রোববার (২০ জুলাই) ঢাকায় এক আলোচনা সভায় হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক একে আজাদ বলেন, "আজ সকালে (রোববার) আমার একজন বায়ার (ক্রেতা) ই-মেইলে জানতে চেয়েছেন, ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হতে যাওয়া অতিরিক্ত ৩৫ শতাংশ ট্যারিফের মধ্যে কতটুকু আমি—সরবরাহকারী হিসেবে—বহন করবো।"

তিনি বলেন, "আমি ওই ক্রেতার কাছে বছরে ৮০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করি, যেখানে আমার মুনাফা থাকে ১ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন ডলার। এখন যদি ওই ৮০ মিলিয়ন ডলারের ওপর ৩৫ শতাংশ ট্যারিফের একটি অংশ আমাকে বহন করতে হয়, তাহলে আমি কীভাবে সেটা সামলাবো?"

প্রায় ৪০ বছরের ব্যবসায়িক জীবনে এমন সংকট আগে কখনো দেখেননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা ব্যবসায়ীরা এই খাতকে সম্মানজনক জায়গায় নিয়ে এসেছি। কিন্তু এখন আমরা চরম হতাশ।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে হতাশার বার্তা আসছে জানিয়ে একে আজাদ বলেন, আমাদের যেসব বড় বড় ব্র্যান্ডের ক্রেতা রয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে চলমান ট্যারিফ নিয়ে আলোচনা ও লবিং করছে। তারা আমাদের জানিয়েছে, 'তোমরা (বাংলাদেশ) খুব একটা ভালো ফলাফল পাবে বলে মনে হচ্ছে না।'"

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরের এক নিটওয়্যার পোশাক কারখানার মালিক—যার ৮০ শতাংশ রপ্তানিই মার্কিন বাজারমুখী বলেন, আমার মার্কিন ক্রেতা বাংলাদেশে আসছে আলোচনা করতে। তারা জানতে চাইছে, আমরা এই বাড়তি ট্যারিফের কতটুকু চাপ নিতে পারবো। এভাবে দীর্ঘমেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ব্যবসা ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। হয়তো একসময় কারখানাই বন্ধ করে দিতে হবে।

বিকল্প বাজার খোঁজা সহজ হবে না

বিজিএমইএ সভাপতি গণমাধ্যমকে বলেন, রাতারাতি এত বড় একটি বাজারের বিকল্প খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। হয়তো কোনোমতে একটি সিজন রপ্তানি করা যাবে, তারপর আর সে বাজারে থাকা সম্ভব হবে না—কারখানা বন্ধ করা ছাড়া গতি থাকবে না।

বিজিএমইএর হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে মোট রপ্তানির ২০ শতাংশ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে এমন কারখানার সংখ্যা ৮২২টি, যাদের রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। মোট রপ্তানির ২১ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত রপ্তানি করা কারখানার সংখ্যা ১৭৬টি, ৪১ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ রপ্তানিকারক কারখানা ৮৭টি, ৬১ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত রপ্তানি করা কারখানা ৯১টি, ৮১ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত রপ্তানিকারক কারখানা ৪৬টি এবং ৯১ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ রপ্তানি করা কারখানার সংখ্যা ১০০টি।

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ট্যারিফ সংক্রান্ত ইস্যুতে আলোচনার জন্য বাংলাদেশের একটি সরকারি প্রতিনিধি দল আজ অথবা আগামীকাল যুক্তরাষ্ট্রে রওনা হতে পারেন বলে জানা গেছে। তবে ওই প্রতিনিধি দলে পোশাক খাতের কোনো বেসরকারি প্রতিনিধি থাকছে না।