Image description

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপিত শুল্কনীতি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে বলে জানিয়েছেন টিভি উপস্থাপক ও সাংবাদিক জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি পৃথিবীর অনেক দেশকেই চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত, যা দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস, এই নীতির ফলে চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ৩৫ শতাংশ শুল্কের সাথে পূর্বের শুল্ক যোগ হলে মোট শুল্কের হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের বস্ত্র শিল্পের প্রতিযোগিতা ও লাভের সম্ভাবনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর অনেক দেশ নেগোশিয়েট করার চেষ্টা করছে। অনেকে ইতিমধ্যেই বোঝা যাচ্ছে, বেশ খানিকটা সফল। তাদের মধ্যে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিযোগী দেশগুলো আছে। বিশেষ করে ভিয়েতনাম এবং ভারতের কথা আমরা বলতে পারি। অবশ্য তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। কিন্তু তাদের আলোচনায় অগ্রগতি আন্ডারস্ট্যান্ডিং যেখানে গিয়ে থেকেছে, সেখানে বলা যেতে পারে, তারা বেশ খানিকটা সফল।’
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইউটিউবের এক আলোচনায় এসব কথা বলেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘নানা চিঠি চালাচালি নানা কিছুর প্রেক্ষিতে এক মাস সময় বেড়েছে এবং আগস্টের ১ তারিখ থেকে এটা কার্যকর হওয়ার কথা। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্র সফর করে এসেছে।’

জিল্লুর রহমান জানান, এর আগে নানা পর্যায়ে, বিশেষ করে বাংলাদেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রে এসব বিষয় নিয়ে দেনদরবার করছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নিরাপদ উপদেষ্টার সঙ্গে এই শুল্কের যার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক কি সম্পর্ক রয়েছে? বা তার সম্পর্কে যে একটা পারসেপশন বাংলাদেশে তৈরি করা হয়েছে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের খুব ঘনিষ্ঠ। তিনি এটা করে ফেলবেন, ওটা করে ফেলবেন। কিন্তু বাস্তবিক তিনি কিছু আসলে করতে পারছেন না। কতটা ঘনিষ্ঠ? 

তিনি বলেন, শেখ হাসিনার আমলে যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে খুব জোরালো অবস্থান নিয়েছিল। বেশ কিছু পদক্ষেপ তারা নিয়েছে। যেটা অন্য দেশগুলো হয়তো নেয়নি। হ্যাঁ, অন্যরা বিবৃতি দিয়েছে। কিছু কিছু ইউরোপ ইউনিয়ন কিছু কিছু হুমকি দিয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে কঠোর একটা অবস্থানে নিয়েছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত এসে তারা কৌশলে খানিকটা বদলে চুপচাপ ছিল। কিন্তু তারা তাদের অবস্থান থেকে সরেনি। 

তিনি আরো বলেন, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই সময়টা তো এই যে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সঙ্গে দেশের ভেতরে দেশের বাইরে যারা দেনদরবার করেছেন, কথাবার্তা বলেছেন বা যুক্তরাষ্ট্রে থাকা যেসব জ্ঞানী-গুণী মানুষ বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের অবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন। এমনকি বিভিন্ন ওয়েবিনারেও যারা কথাবার্তা বলেছেন বাংলাদেশের এই নিরাপত্তা উপদেষ্টা কি এর কোথাও কোনো দিন ছিলেন? ছিলেন না। এমন একটা আবহ তৈরি করা হয়েছে যে তিনি সব করে ফেলবেন। তিনি লন্ডন বৈঠক করে দিয়েছিলেন। তিনি এটা করে ফেলবেন। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কিছু সীমাবদ্ধতা দুর্বলতা তো আছেই তাদের। নিঃসন্দেহে তারা আমাদের সবার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ তাদের সমর্থন করে। 

আমরা দেখলাম, একটা প্রতিনিধিদল বাণিজ্য উপদেষ্টার নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রে গেছে। কোনো সাফল্য আসেনি। কোনো চুক্তি করতে পারেনি। প্রশ্ন উঠেছে, যারা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে গেলেন এবং এই বিষয় নিয়ে যারা ডিল করেন তাদের সঙ্গে আলোচনার সক্ষমতা তাদের কতখানি ছিল? বাংলাদেশের নেগোসিয়েশন স্কিল যেকোনো ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুর্বল। আমরা জানি, কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড রিসার্চ করে আমাদের প্রতিনিধিরা তেমন একটা যান না। এমনকি ভারতীয়-পাকিস্তানিরা যেভাবে দর-কষাকষি করতে পারেন বাংলাদেশ কোনো দিনই পারে না। ভারতের সঙ্গেও বাংলাদেশ অনেক সময় পারে না। 

এই জায়গাটায় একটা বড় দুর্বলতা। যারা গেলেন তারা কি আমাদের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে গেছেন? তারা কি অর্থনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলেছেন? তারা কি আমাদের রপ্তানিকারকদের সঙ্গে ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন? আমি মনে করি, এই প্রতিনিধিদল তাদের কয়েকজনকে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে নিয়েও যেতে পারতেন। না পারলে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে তাদের যুক্ত করতে পারতেন। না পারলে তাদের হোটেলে রেখে এই যে তারা এতগুলো মিটিং করেছেন। তিন-চার দিন ধরে মিটিং করেছেন। সকাল-বিকাল ৩০-৪০টা মিটিং তারা করেছেন। নিশ্চয়ই ব্রেক পেয়েছেন। এই ব্রেকগুলোতেও তারা কিন্তু অন্যদের সঙ্গে কনসাল্ট করতে পারতেন। তারা এটা করেননি এবং যারা গেছেন, আমি তাদের সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলতে চাই না। 

অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, তাদের আসলে কি যোগ্যতা ছিল? তারা আসলে কতটা সফল হয়েছেন? এসে তারা প্রেস কনফারেন্স বা ব্রিফিং করেছেন। সাংবাদিকদের সেখানেও তাদের যে পারফরমেন্স দেখলাম, তারা সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। মানুষ উত্তেজিত হয় যখন তার লিমিটেশনস থাকে। মানুষ উত্তেজিত হয় যখন দুর্বলতা থাকে। অধিকাংশ সময় দু-একটা ছোটখাটো বিষয় ব্যতিক্রম। এটা কিন্তু আমরা দেখলাম। 

একজন উপদেষ্টা ধারণা দিলেন, এখানে সিকিউরিটির কিছু ইস্যু আছে। যুক্তরাষ্ট্র এটা চায়, ওটা চায়। এ রকম একটা আবহও কিন্তু বাংলাদেশে তৈরি করবার চেষ্টা করছে। হ্যাঁ। যুক্তরাষ্ট্র কিছু কিছু বিষয় চাইতেই পারে। চায়, আপনিও চান না। আমরাও চাই। সবাই চায়। যে যার দেশের স্বার্থ দেখবে। আপনি রপ্তানি সুবিধা নেবেন, ব্যবসা করবেন। সে কিছু চাইতে পারে না? কিন্তু হ্যাঁ, আপনি দেশের স্বার্থ বিপন্ন করে কিছু করবেন না।

আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্র যেমন জিসোমিয়াসহ নানা কিছু নিয়ে অনেক দিন ধরে দেন-দরবার করছে। বাংলাদেশের লেবার রাইটস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দেন-দরবার করছে। এগুলো যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিয়ে করছে। কোনো কিছু গোপন না। এটা শেখ হাসিনার ওই সেন্ট মার্টিন দ্বীপ চাইছের মতো হয়ে গেল। এটা চাইছে, ওটা চাইছে। তাহলেই ক্ষমতায় থাকতে পারব, পারতাম। ব্যাপারটা এ রকম না। ওরা যা চাইছে, সেটা ঘোষণা দিয়ে চাইছে। তো আপনি এগুলো নেগোশিয়েট করেন। সেটা করতে আপনি কেন পারছেন না? এটাই হচ্ছে আমার প্রশ্ন।

একটা বহুপক্ষীয় শক্তিশালী দল ছিল। কিন্তু এর বাইরে যে কথাগুলো হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এটা চায়। বাংলাদেশের ওটা চায়। এখান থেকে এই করিডর-টরিডর নানা কিছু নিয়ে যেগুলো আলোচনা হচ্ছে, সেগুলো চায়। তো যদি চায়, আর না পারেন জাতিকে জানান। আবার বলছেন যে জনগণকে এটা জানানো যাবে না, নন-ডিসক্লোজেজ। তো জানানো যাবে না কেন? কি জানানো যাবে না? দেশের হয়ে আপনি চুক্তি করবেন। আপনাকে কে সেই ক্ষমতা বা অধিকার দিল? দেশের জনগণকে না জানিয়ে আপনি অন্য আরেকটা দেশের সঙ্গে চুক্তি করবেন? এ অধিকার আপনাকে কেউ দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রেরও কোনো কর্মকর্তা কোনো মন্ত্রী এই চুক্তি করে ফেলতে পারবেন না, তার সিস্টেমকে না জানিয়ে, তার জনগণকে না জানিয়ে। তা আপনি এটা করবেন। আপনি জানাবেন না। সব কথার মূল কথা হচ্ছে যে নিজেদের দুর্বলতা ঢাকবার জন্য এই কথাগুলো বলবার একটা চেষ্টা হচ্ছে। 

পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যেখানে অত্যন্ত সফলভাবে নেগোশিয়েট করতে পারছে, সুবিধা আদায় করতে পারছে আমরা সেটা পারছি না। আমরা কেবল বিদেশে যাই অনেকটা প্লেজার ট্রিপের মতো। এগুলো আসলে বন্ধ করতে হবে। এগুলো বন্ধ করতে হবে এবং এই যে একটা ধারণা, সরকারের সঙ্গে অনেকেই মনে করছে, এই সরকারের সঙ্গে খুব একটা যুক্তরাষ্ট্রের আহামরি সম্পর্ক। যুক্তরাষ্ট্রই তাদেরকে সব কিছু গাইড করছে। আমি আমি মনে করি, ব্যাপারটা এ রকম নয়।

অনেকেই মনে করেন, এই সরকারকে দীর্ঘদিন ক্ষমতা রাখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। আমি এটা ভাবতে রাজি না। আমি মনে করি, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার চায়। অন্যান্য শক্তিগুলো চায়। তাদের অনেকের ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেকের যে মোহ ছিল রিফর্মের সেই মোহ তাদের ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে বলে আমার ধারণা। কাজেই নিজের ব্যর্থতার দায় অন্যের ওপর চাপিয়ে দিয়ে কোনো লাভ নেই। আমি মনে করি, বাংলাদেশের এই সমস্যাগুলো সমাধান করা খুব জরুরি। আমি এটাও জানি, মোটামুটিভাবে আমার ধারণা যে বাংলাদেশের এই স্পেশাল শুল্কের ইস্যুতে দর-কষাকষির জন্য বাংলাদেশকে যদি ছাড় দিতে হয়, কারণ ছাড় তো আপনাকে দিতেই হবে। 

কিছু আপনাকে পেতে হলে ছাড় দিতে হবে। কেউ নিজের স্বার্থ ছাড়া আপনাকে কিছু দেবে না। যা দেয় সেটা তো দেয়। অনুদান দেয়, ডোনেশন দেয়, ফাইনান্সিয়াল অ্যাড দেয় সেটা এক জিনিস। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে সব ক্ষেত্রে এটা হবে না। আর আপনি সেটা চাইবেনই কেন? আপনার কাছে কেউ চাইলে আপনি কি দিয়ে দিতে পারেন বা দেন? সে ক্ষেত্রে আমি মনে করি যে সরকারের এই নেগোশিয়েশনের প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপিসহ গুরুত্বপূর্ণ দলগুলো, আরো বিশেষ করে বিএনপি সরকারকে মোটামুটি একটা সমর্থন দিয়েছিল বা এ রকম একটা ধারণা দিয়েছিল দেশের স্বার্থে। কারণ এটা দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। যদি কোথাও কোনো ছাড় দিতে হয়, যাতে সেটা আমাদের জন্য খুব বড় ক্ষতি না হয় এবং বিপদগ্রস্ত আমরা হই এ রকম কিছু না হয়, যদি সেটা আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকার সেই নেগোশিয়েশনের প্রক্রিয়ার মধ্যে এগুতে পারে কিন্তু আসলে সেটা করবার জন্য তো সক্ষমতা দরকার। সেই সক্ষমতা কি এই সরকারের আছে বা সেই সদিচ্ছাই কি তাদের আছে? আমি তো মনে করি, তারা প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ স্বার্থে কাজ করছেন। দেশের স্বার্থ তাদের বিবেচনার মধ্যে নেই।