
১৯৫৯ সালে ভাষা আন্দোলনের ধারা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্রসমাজ নতুন করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী পালনের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠীর বিরোধিতা প্রকাশ পায়। একই বছরে কমিউনিস্ট পার্টি ও আওয়ামী লীগের বৈঠকের পর ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের বৈঠকে সামরিক শাসনের পরিবর্তে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, আইয়ুব শিক্ষানীতি বাতিল, রাজবন্দীদের মুক্তিসহ নানা দাবিতে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত হয়। নির্ধারিত হয় যে ১৯৬২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হবে স্বৈরাচারবিরোধী জঙ্গি আন্দোলন।
৩০ জানুয়ারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারের পর ছাত্ররা আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ধর্মঘট, বিক্ষোভ ও মিছিল সংঘটিত হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে বের হওয়া ছাত্র ইউনিয়নের মিছিল সেনাবাহিনী দ্বারা প্রতিহত হয়, এমনকি কার্জন হলে ফিল্ড কামান বসানো হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি পুলিশ-সেনা বিশ্ববিদ্যালয় ঘেরাও করে আন্দোলন দমন করার চেষ্টা চালায়। এর পরেও সারা দেশে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৬২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে সরকার ঘোষিত শিক্ষানীতি ছাত্র আন্দোলনকে নতুন গতি দেয়। তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স বাতিল ও উচ্চমাধ্যমিকে ইংরেজির বাড়তি চাপ প্রত্যাহার ছাত্রসমাজের প্রধান দাবি হয়ে ওঠে। ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ মিলে পাকিস্তান স্টুডেন্ট ফোরাম গঠন করে আন্দোলনকে সংগঠিত করে। আগস্ট মাস জুড়ে মিছিল, ধর্মঘট ও সমাবেশে দাবিগুলো ছড়িয়ে পড়ে।
১০ আগস্ট ঢাকা কলেজে বৈঠক থেকে ১৫ আগস্ট ছাত্র ধর্মঘট ও ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে তা পরিবর্তন করে ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেওয়া হয়। ওইদিন ঢাকাসহ সারাদেশে পুলিশ গুলি চালায়। বাবুল, গোলাম মোস্তফা ও ওয়াজিউল্লাহ নামে তিন ছাত্র এবং টঙ্গিতে শ্রমিক সুন্দর আলী শহীদ হন। তবে রাজনৈতিক নেতারা শুধু বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ থাকায় আন্দোলনের গতি কিছুটা মন্থর হয়ে পড়ে।
এই শিক্ষা আন্দোলন ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, শিক্ষার সার্বজনীন অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং জাতীয় মুক্তির প্রত্যাশার অংশ। স্বাধীনতার পরও ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ধাঁচের শিক্ষানীতি বহাল থেকে যায়। ২০১১ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতেও মূলত শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ও বেসরকারীকরণকে উৎসাহিত করা হয়েছে। ফলে শিক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে পণ্য, যা সামর্থ্যবানদের কাছে সীমাবদ্ধ।
আজও আলাদা বেতন কাঠামো, শিক্ষা আইনের বাস্তবায়ন ও শিক্ষার বৈষম্যহীনতার প্রশ্নে আন্দোলন চলছে। বিশ্বব্যাংকের কৌশল, পিপিপি প্রকল্প, ইভিনিং শিফট প্রভৃতি শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার, যা ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার জন্য নিশ্চিত করা জরুরি।
শিক্ষা হবে বিজ্ঞানভিত্তিক, জীবনঘনিষ্ঠ, মানবিক ও আধুনিক, যা সচেতন, দক্ষ, দেশপ্রেমিক নাগরিক গড়ে তুলবে। অতীতের সংগ্রামী ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে আজও ছাত্রসমাজের দায়িত্ব হলো নতুন প্রজন্মকে জাগ্রত করা।
অঙ্গীকার হোক; সার্বজনীন, বৈষম্যহীন ও আধুনিক শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের।
Comments