
ইউরোপের নর্থ মেসিডোনিয়ায় মর্মান্তিক এক সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত রাজিবের মৃতদেহ শেষবারের মতো ছু্ঁয়ে দেখতে চায় মা মমতাজ বেগম। পরিবারের বড় সন্তানকে হারিয়ে শোকে বিহ্বল মায়ের আর কোনো চাওয়া নেই। একটি বারের জন্য হলেও বুকের মানিকের মুখ দেখতে চায় সে।
সন্তান হারিয়ে শোকে কাতর মা-বাবার আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে পরিবেশ। শোকের ছায়া নেমে এসেছে পুরো পৌরসদরে। পরিবার, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব কেউ-ই মেনে নিতেই পারছেনা রাজিবের এই অকাল প্রয়াণ। মাত্র তিন মাস আগে সাংসারিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে ওয়াল্ডার ভিসায় পাড়ি জমিয়েছিলেন ইউরোপের দেশ নর্থ মেসিডোনিয়ায়। সেখানে কাজে যাওয়ার সময় গত ১২ সেপ্টেম্বর এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিন বাংলাদেশীসহ নিহত হন রাজিব শিকদার। শৈশব থেকেই পরিশ্রমী ও অত্যন্ত মেধাবী রাজিব বিজ্ঞান বিভাগে বোয়ালমারী সরকারী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাশ করে। পরে উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে অনার্সে ভর্তি হলেও সাংসারিক অর্থাভাবে পিতার ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের হাল ধরেন রাজিব। পিতার দুই সংসার, দ্বিতীয় স্ত্রীর একমাত্র সন্তান সে। অন্য ঘরে আরও দু ভাই থাকলেও মেধাবী,কর্তব্যজ্ঞান ও আচার ব্যবহারে দু'মায়ের কাছেই স্নেহের, আদরের সন্তান ছিলো রাজিব। মায়ের সাথে রাজিব গুনবহায় থাকলেও বড় মায়ের কাছে কৈশোর যৌবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে। নম্র, ভদ্র ও বন্ধুবাৎসল্য স্বভাবের কারণে তার মৃত্যুতে শোকাহত হয়েপরে পৌরসভার দুটি এলাকা।
পিতা আতিয়ার রহমান আতি শিকদার পৌরসভার পশ্চিম ছোলনার আদি বাসিন্দা হলেও দ্বিতীয় বিয়ের পর পার্শ্ববর্তী গুনবহা গ্রামে অপর একটি বাড়ি করেন। সেখানেই মাকে নিয়ে থাকতো রাজিব। দুই সংসারের চালাতে গিয়ে হিমশিম খাওয়া পিতার কষ্ট লাঘোবে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেই পিতার ইঞ্জিনিয়ার ওয়ার্কশপে কাজ শিখে ব্যবসার হাল ধরেন সে। বিয়ের বয়স হলেও সংসার ও নিজের ভাগ্য পরিবর্তনে ঋণ ও ধার দেনা করে ইউরোপে পাড়ি জমান। যাবার আগে মাকে বলেছিল দু'বছর কাটিয়ে দেশে ফিরে বিয়ে করবে সে। কিন্তু ভাগ্যের চরম পরিণতির কাছে সব আশা আকাঙ্খা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। একদিকে সন্তানের মৃত্যু শোক অন্য দিকে বিভিন্ন এনজিও ও ব্যাংকের ঋণের বোঝা। সেই সাথে যোগ হয়েছে মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ায় জটিলতা। ব্যক্তগত ভাবে সন্তানের মৃতদেহ দেশে ফিরিয়ে আনতে লাগবে প্রায় ১৫ হাজার ইউরো যা বাংলাদেশেরী টাকায় প্রায় ২১ লাখ টাকা।
সন্তানকে বিদেশ পাঠাতে গিয়ে প্রায় ১৫ লাখ টাকা ধারদেনা ও ঋণ করে এখন নিঃস্ব রিক্ত পরিবারটির বসতবাড়ির ভিটেমাটি ছাড়া আর কিছুই নেই তবুও আবদার নেই কারোকাছে শুধু মৃত সন্তানের মৃতদেহটা কাছে পেতে চাই। পিতা আতিয়ার রহমান শিকদার সমাজের বৃত্তবান ও সরকারের নিকট গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে আবেদন জানিয়েছে যাতে সরকারি খরচে তার সন্তানের মৃতদেহ দেশে আনার - তিনি বলেন -“আমার সন্তানের লাশ যেন দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে সরকার।” কথা বলার সময় বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
নিহতের মা মমতাজ বেগম আবেগ তাড়িত কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “শেষবারের মতো আমি আমার ছেলের মুখ দেখতে চাই, আমার বুকের মানিকের মুখ ছুঁয়ে দেখতে চাই, আমার কলিজার টুকরোর কবরডা দেশের মাটিতে যেন হয়। আপনারা আমার বাজানরে আইনে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন আর কোন চাওয়া নাই আমার সন্তানের হাড়গোড় গুলোও আমারে দেন।
বোয়ালমারী পৌরসভার সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী জেলা যুবদলের সহ-সম্পাদক ইমরান হুসাইন বলেন, “ বিদেশে গিয়ে তিন মাস কাজ করার পরই সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক, দুর্বল। ব্যক্তগত ভাবে তাদের পক্ষে মরদেহ ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। তাই আমি সরকারের নিকট আবেদন করি যাতে সরকারি খরচে তার মরদেহ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে সরকার।”
বোয়ালমারী পৌর জামায়াতের সেক্রেটারি সৈয়দ সাজ্জাদ আলী বলেন, “প্রতিটি মৃত্যু বেদনাদায়ক। কিন্তু তা যদি মাতৃভূমি থেকে দূরে ঘটে তবে কষ্ট আরও হৃদয় বিদারক। রাজিব একজন রেমিট্যান্স যুদ্ধা দেশের উন্নয়নের অংশিদার, পরিবারের মরদেহ ফিরিয়ে আনা সাধ্য নাই । তাই আমি সরকারসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানাই, এই রেমিট্যান্স যুদ্ধার মরদেহ সরকারী খরচে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক।”
Comments