Image description

শরীয়তপুরে সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গড়ে ওঠা বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা। এই চক্রের কারণে সরকারি অ্যাম্বুলেন্স সেবা সীমিত হয়ে পড়েছে, ফলে জরুরি মুহূর্তে রোগী পরিবহনে সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। গত বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) রাতে একটি চক্রের বাধায় ঢাকা থেকে আসা অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেওয়ার কারণে এক নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত সবুজ দেওয়ানকে শনিবার (১৬ আগস্ট) পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

নবজাতকের মৃত্যু ও জনরোষ

নিহত নবজাতকের মা রুমা বেগম শুক্রবার থেকে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। তিনি বলেন, “আমার কলিজার টুকরাকে ১০ মাস শরীরে আগলে রাখলাম। কেন সে চলে গেল? আমি এখন কাকে নিয়ে বাঁচব?” নবজাতকের বাবা নূর হোসেন বলেন, “আমরা গরিব মানুষ, প্রথমে মামলা করতে চাইনি। পরে সাহস পেয়ে মামলা করেছি। দ্রুত অপরাধীদের বিচার চাই।” এ ঘটনায় পালং মডেল থানায় মামলা দায়ের হয়েছে, এবং আসামি সবুজ দেওয়ানকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে বলে জানান ওসি হেলাল উদ্দিন।

সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের সীমাবদ্ধতা

শরীয়তপুরে সরকারি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে মাত্র ৭টি। সদর হাসপাতালে আছে ২টি, তবে একটি দীর্ঘদিন ধরে বিকল। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৫টি থাকলেও ভেদরগঞ্জে নেই কোনো চালক। অথচ জেলার ৫০ শয্যার ৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ২০ শয্যার একটি থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ১০০ শয্যার জেলা সদর হাসপাতালে প্রতিদিন ৮০–১০০ জন রোগীকে ঢাকায় নিতে হয়। মাসিক হিসাবে এই সংখ্যা দাঁড়ায় আড়াই থেকে তিন হাজার। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে মাসে সর্বোচ্চ ৫০–৬০ জন রোগী বহন করা সম্ভব হয়, বাকি সবাইকে নির্ভর করতে হয় বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সে।

অ্যাম্বুলেন্স চক্রের দৌরাত্ম্য

জানা গেছে, স্বাস্থ্য বিভাগের বর্তমান ও সাবেক কর্মচারীদের একটি অংশ এই অ্যাম্বুলেন্স চক্র গড়ে তুলেছে। তাঁদের নিয়ন্ত্রণে অন্তত ২০টি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। এই চক্র সরকারি অ্যাম্বুলেন্স চালকদের সঙ্গে যোগসাজশে রোগী পরিবহন করে এবং অন্য জেলা থেকে আসা অ্যাম্বুলেন্সে রোগী তুলতে বাধা দেয়। গ্রেপ্তার হওয়া সবুজ দেওয়ান এই চক্রের অন্যতম সদস্য, যার বাবা তাহের দেওয়ান সিভিল সার্জনের গাড়ির চালক। সদর হাসপাতালের চালক জাহাঙ্গীর হোসেনের বিরুদ্ধেও একাধিক অ্যাম্বুলেন্স মালিকানার অভিযোগ রয়েছে, যদিও তিনি তা অস্বীকার করেছেন।

সরকারি সেবার অভাব

গতকাল (১৬ আগস্ট) সকালে সন্তানসম্ভবা অর্চনা মণ্ডলকে (২৩) গুরুতর অবস্থায় ঢাকায় নিতে সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। বাধ্য হয়ে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করা হয়, কিন্তু ঢাকায় পৌঁছানোর পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। চালক জাহাঙ্গীর দাবি করেন, “সকালে অ্যাম্বুলেন্স গ্যারেজে এসি মেরামতের জন্য ছিল, কোনো রোগীর স্বজন ফোন করেননি।”

চড়া ভাড়া ও নীতিমালার অভাব

সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় রোগী পরিবহনে গড়ে ৪,০০০–৫,০০০ টাকা খরচ হলেও চক্রের নিয়ন্ত্রিত বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সে ৮,০০০–১০,০০০ টাকা দিতে হয়। জেলা অ্যাম্বুলেন্স মালিক ও চালক সমিতির সভাপতি আবদুল হাই বলেন, “স্থানভেদে ৭,০০০–৮,০০০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়।” জেলার সিভিল সার্জন রেহান উদ্দিন বলেন, “বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স চলাচলে কোনো নীতিমালা নেই, তাই তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিকল অ্যাম্বুলেন্স মেরামত ও চালক নিয়োগের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে জানানো হয়েছে।”

জনগণের দাবি

নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনা এবং অ্যাম্বুলেন্স চক্রের দৌরাত্ম্য নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। তারা বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ন্ত্রণে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন, সরকারি অ্যাম্বুলেন্স সেবার উন্নতি এবং দোষীদের দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়েছেন। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে জরুরি স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে আরও দুর্ভোগ বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।