
সচল নেই একটিও সরকারি অ্যাম্বুলেন্স, নেই চালকও। ফলে পুরোটাই সিন্ডিকেটের দখলে অ্যাম্বুলেন্স সেবা। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স এনে জেলার সবচে’ বড় হাসপাতালে ওয়ার্ড বয়কে দিয়ে নামেমাত্র চালু রাখা হয়ে সেবা। কৌশলে রোগীদের ঠেলে পাঠানো হয় বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স-এর দিকে। এতে ইচ্ছে মতো ভাড়া নিচ্ছে এর মালিক-চালকরা। বিষয়টি বছরের পর পর চললেও যেন দেখার কেউই নেই। যদিও সমস্যা গতানুগতিক সমাধানের আশ্বাস স্বাস্থ্য বিভাগের।
কথা হয় মাদারীপুরের পখিরা গ্রামের মৃত জসিম তালুকদারের স্ত্রী রিজিয়া বেগমের সাথে। স্বামী হারা রিজিয়া তার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন ধারদেনা করে। সেই ঘরে জন্ম নেয় ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান। শিশুটি অসুস্থ হওয়ায় ভর্তি করা হয় মাদারীপুর ২৫০ শয্যা জেলা হাসপাতালে। চিকিৎসক ফরিদপুর মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাবার পরামর্শ দিয়েছেন। হাসপাতালের বারান্দা ও চারপাশে তিনদিন ঘুরেও পাননি ভাড়ার সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের সেবা। পরে সুদে টাকা এনে ৩৫০০ টাকায় ঠিক করেন বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স। মাদারীপুরের পখিরা গ্রামের অসহায় রিজিয়ার মতো সরকারি অ্যাম্বুলেন্স সেবা নিয়ে এমন অভিযোগের শেষ নেই রোগী ও স্বজনদের।
সারি সারিভাবে হাসপাতালের ভেতর দখল করে আছে দুই ডজনেরও বেশি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স। অথচ, সরকারি এই হাসপাতালে ৬টি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও সবই অচল। রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে একটি পুরনো অ্যাম্বুলেন্স এনে ওয়ার্ডবয়কে দিয়ে কোন মতে চলছে সেবা। ফরিদপুর ও বরিশাল মেডিকেলে যাতায়াতের জন্য ১৫৫০ টাকা ও রাজধানী ঢাকায় ৪৬০০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া স্বাস্থ্য বিভাগ। সরকারি অ্যাম্বুলেন্স সেবা ঝিমিয়ে পড়ায় দ্বিগুনেরও বেশি ভাড়া হাতিয়ে নিচ্ছে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স চালক-মালিকরা। অবশ্য, ঝিমিয়ে পড়া অ্যাম্বুলেন্সের সেবা বাড়াতে অনেকটাই অসহায়ত্বের কথা জানায় সিভিল সার্জন।
সদর উপজেলার হাউসদি গ্রামের ফরহাদ বলেন, ‘সরকারি অ্যাম্বুলেন্স কখনই পাওয়া যায় না। বেসরকারিতে বেশি টাকা দেয়া লাগে। সিরিয়াল ছাড়া কেউ যেতে পারে না। আমরা রোগী ও স্বজনরা তাদের কাছে জিম্মি। এর থেকে আমরা মুক্তি চাই।’
আলী হোসেন নামে এক দিনমজুর বলেন, ‘আমার ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করি। সরকারি সেবা না পেয়ে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ফরিদপুর যাচ্ছি। এতগুলো টাকা সংগ্রহ করা আমার পক্ষ অসম্ভব ছিল। পরে ধারদেনা হয়ে সাড়ে তিন হাজার টাকায় ফরিদপুর যাচ্ছি।’
রফিকুল ইসলাম নামে রোগীর এক স্বজন বলেন, ‘আমার রোগীকে ঢাকায় নিতে ৮৫০০ টাকা দিতে হয়েছে। বাহির থেকে কোন অ্যাম্বুলেন্সে আমি যেতে পারিনি। সদর হাসপাতালের ভেতরে রাখা অ্যাম্বুলেন্সেই যেতে হবে। এ যেন অনিয়ন্ত্রিত নিয়ম। আমরা রোগী ও স্বজনরা জিম্মি হয়ে পড়েছি।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কোনটির চাকা হাওয়া বের হয়ে মাটির সাথে মিশে গেছে, কোনটির আবার যন্ত্রাংশও চুরি হয়েছে। দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ায় অকেজো হয়ে হাসপাতালের পেছনে পড়ে আছে সরকারি অ্যাম্বুলেন্সগুলো। এতে কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছেন না জেলাবাসী। এদিকে রোগীবহনকারী অ্যাম্বুলেন্সগুলোতে পদ্মা সেতু পারাপারে টোল ফ্রি করেছে কর্তৃপক্ষ।
বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স চালক আরিফ কাজী বলেন, ‘আমরা ফরিদপুর গেলে ৩০০০ থেকে ৩৫০০ টাকা নেই। আর ঢাকায় গেলে ৭৫০০-৮০০০ টাকা নেই। এর বেশি আমরা নেই না। ঢাকা গেলে রোগী থাকলে পদ্মা সেতুতে টোল লাগে না, তবে খালি গাড়ি থাকলে টোল দিতে হয়। এছাড়া মৃতদেহ থাকলেও টোল দিতে হয়।’
সরকারি অ্যাম্বুলেন্স চালক (ওয়ার্ড বয় হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত) সোহরাব তালুকদার বলেন, ‘সদর হাসপাতালে একটি অ্যাম্বুলেন্স সচল নেই। রাজৈর থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স এনে সেবা প্রদান করা হচ্ছে। রোগীরা কল দিলে বা ডাক দিলে তাদের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাই। রোগীরা আমাকে পায় না, এমন অভিযোগ সঠিক নয়। সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় প্রতিমাসে আমি ২০-২৫টি ট্রিপ দেই।’
মাদারীপুরের সিভিল সার্জণ ডা. মোহাম্মদ শরীফুল আবেদীন কমল বলেন, ‘হাসপাতালের চারপাশে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স চালকরা দখল করে আছে ঘটনাটি সত্য। এই বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স মালিক ও চালকদের সাথে বসে শিগগিরই এর একটি সমাধান করতে হবে, যাতে রোগীরা হয়রানী ও ভোগান্তিতে না পড়েন। কেউ যেন জিম্মি করে বাড়তি ভাড়া না নিতে পারে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে। আর সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের সেবার মান বাড়াতে কাজ করছে স্বাস্থ্য বিভাগ।’
Comments