Image description

পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্পে ঋণের টাকা ছাড় বন্ধ করে দিয়েছে চীন। দফায় দফায় চিঠি দিয়েও মিলছে না কোনও সাড়া। এদিকে ব্যয় কমিয়েছে বলে ঋণের টাকা ফেরত দিচ্ছে সরকার; অথচ প্রকল্পের অন্য খাতে যে খরচ বেড়েছে, সেটি সমন্বয় করেনি। এমন পরিস্থিতিতে চীন ঋণের টাকা ছাড় না দিলে বাড়তি কাজের ব্যয় বাবদ বিশাল ভর্তুকি দিতে হবে সরকারকে।

সবশেষ গত ২ জুলাই পরিকল্পনা কমিশনের আওতাধীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) রেল কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এ-সংক্রান্ত একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে ভ্যারিয়েশনের (মূল পরিকল্পনার বাইরে বাড়তি কাজের ব্যয়) খরচের পুরো টাকা ঋণ বাবদ না পাওয়ার আশঙ্কা নিয়েও আলোচনা হয়। 

জানা গেছে, দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে ঋণ সমন্বয়ের বিষয়ে সমঝোতা না হলে এই প্রকল্পে প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে সরকারকে।

ঋণ চুক্তিতে ভ্যারিয়েশনের জন্য বরাদ্দ ছিল ৪২.৩৮ মিলিয়ন ডলার। চুক্তির সময় প্রতি ডলারের বিপরীতে ৭৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ওই হিসাবেই ভ্যারিয়েশনে খরচ বরাদ্দ ছিল ৩৩৪ কোটি টাকা। কিন্তু, প্রকল্পের এই খাতে খরচ হয়েছে এক হাজার ৮০ কোটি টাকা। এখন বাকি টাকা যদি চীন না-ও দেয়, তাহলেও আইন অনুযায়ী চুক্তির ব্যত্যয় হবে না।

ভ্যারিয়েশনের কাজের মধ্যে মূলত কারিগরি জটিলতা ও নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণে খরচ বেড়েছে। মূল পরিকল্পনার বাইরে আন্ডারপাস, লেভেল ক্রসিংগেট, রেলসেতু বানাতে এবং রেললাইন উঁচু করতে খরচ বেড়েছে। কমলাপুরের কাছে টিটিপাড়ায় প্রথমে আন্ডারপাস ছিল না। যান চলাচলের সুবিধা ঠিক রাখতে পরবর্তী সময়ে এখানে আন্ডারপাস যুক্ত করা হয়। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথ ধরে পদ্মা সেতুর ট্রেনগুলো চলাচল করে। ওই পথে পদ্মার ট্রেন চলাচলের গতি ঠিক রাখতে আরেকটি নতুন লাইন নির্মাণের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এতেও প্রকল্পে অতিরিক্ত খরচ বেড়েছে। এছাড়া ফরিদপুরের ভাঙ্গা জংশন স্টেশনে মূল পরিকল্পনার বাইরে বেশ কিছু সংযোজন হয়েছে। এসব খরচের টাকা দিতে চাচ্ছে না চীন।

এদিকে প্রকল্প সূত্র বলছে, হাতে সময় খুবই কম। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ঋণের টাকার নিষ্পত্তি হতে হবে। এরপর আর হয়তো ঋণ পাওয়া যাবে না। শেষ ধাপে ঋণ চুক্তির ২৬০ মিলিয়ন ডলার ছাড় হওয়া বাকি ছিল। সেখান থেকে প্রকল্পের ব্যয় কমায় ১৬০ মিলিয়ন ডলার ফেরত দেওয়া হয়েছে। বাকি ১০০ মিলিয়ন ডলার চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না।

এই ঋণ জটিলতায় বিপাকে পড়েছে ঠিকাদারও। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে ১৬৯ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত। পুরো পথে এখন নিয়মিত ট্রেন চলাচল করছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণ দিয়েছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। এখন ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান অর্থছাড় না করায় ঠিকাদারের পাওনা আটকে আছে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ১০টি বিল বাবদ ঠিকাদারের প্রায় ১ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। অর্থছাড়ের জন্য নিয়মিত যোগাযোগ করা হলেও সায় দিচ্ছে না ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান। এ পর্যন্ত অন্তত চারবার এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে প্রকল্প কর্তৃপক্ষের বৈঠক হয়েছে। এক্সিম ব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদল প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে গেছে; কিন্তু ঋণ ছাড়ে কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না।

প্রকল্পের আওতায় নির্মিত রেলপথে ট্রেন চলাচল শুরু হলেও বেশ কিছু জায়গায় প্রকল্পের বড় কয়েকটি কাজ বাকি। অগ্রগতির নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রাজধানীর কমলাপুরে টিটিপাড়ায় আন্ডারপাস নির্মাণকাজের প্রায় ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাকি রয়েছে ভাঙা জংশনের নির্মাণকাজ। শেষ হয়নি লুপ লাইনের কাজগুলোও। কিন্তু, ঠিকাদারের বিল বাকি থাকায় এই কাজগুলোও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। 

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুটোই চীনের। আমাদের কাজ প্রায় শেষ। আশা করছি, শেষ মুহূর্তে হলেও ঋণের টাকা ছাড় করা হবে। তা না হলে ঠিকাদার বিপদে পড়ে যাবে।

বিশেষজ্ঞরা এই সংকটের পেছনে কারণ হিসেবে রাজনৈতিক সমীকরণের বিষয়টি সামনে আনছেন। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্ক কেমন, সেটিও তারা নজরে রাখতে চাচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে সম্পর্ক ঠিক থাকলে জি-টু-জি প্রকল্পের অনেক কিছুই সহজে পরিবর্তন করা যায়। আর কূটনৈতিক জটিলতায় সহজ হিসাবও কঠিন হয়ে যায়।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, আমরা চুক্তি করার সময় দক্ষতার পরিচয় দিতে পারছি না। তাই এই ধরনের জটিলতার মুখে পড়তে হচ্ছে। চুক্তির ব্যত্যয় যদি না হয় তাহলে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানকে কিছু বলার সুযোগ থাকে না। তবে জি-টু-জি প্রকল্পের ক্ষেত্রে দুই দেশের সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়। এসবের অনেক কিছু কূটনৈতিক সমীকরণের ওপরও নির্ভর করে।