জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় নিয়ে ঐকমত্য নেই, সরকারের সায় সত্ত্বেও বিভক্ত রাজনৈতিক মহল

বাংলাদেশে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের একটি অফিস স্থাপনের অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের পর থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সরকার এই পদক্ষেপকে ইতিবাচক দেখলেও ইসলামপন্থী দল হেফাজতে ইসলাম এবং বামপন্থী কয়েকটি দল এর তীব্র বিরোধিতা করছে। অন্যদিকে, বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য না দিলেও দলটির শীর্ষ নেতারা এ সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
ইসলামপন্থী ও বামপন্থীদের আপত্তির কারণ:
হেফাজতে ইসলাম এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর মতো ইসলামপন্থী দলগুলো মনে করে, বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপিত হলে তা দেশের ইসলামী মূল্যবোধ, পারিবারিক আইন এবং ধর্মীয় সংস্কৃতিতে হস্তক্ষেপ করবে। হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ মহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেছেন, “অতীতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘মানবাধিকারের’ নামে ইসলামী শরিয়াহ, পারিবারিক আইন ও ধর্মীয় মূল্যবোধে হস্তক্ষেপের অপচেষ্টা করেছে।” তাদের আশঙ্কা, এই অফিস সমকামিতা, কাদিয়ানি (আহমদিয়া), সংখ্যালঘু, পাহাড়ি এবং নারী স্বাধীনতার নামে ইসলামের বিধিবিধানের বাইরে কাজ করবে, যা দেশের জন্য ক্ষতিকর। তাদের মতে, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় কোনো ঘটনা নেই এবং যা আছে, তা সরকারই দেখছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)-এর মতো বামপন্থী দলগুলো ভিন্ন কারণে বিরোধিতা করছে। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স মনে করেন, বাংলাদেশ এমন কোনো দীর্ঘমেয়াদী সংকটে নেই যার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় প্রয়োজন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, "জাতিসংঘ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় নিরপেক্ষ ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে এমন কোনো প্রমাণ নাই। তারা সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদীর স্বার্থরক্ষা করছে।" সিপিবি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ারও সমালোচনা করেছে।
সরকারের নীতিগত অনুমোদন ও প্রক্রিয়া:
গত ২৯ জুন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানান, উপদেষ্টা পরিষদ জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের ঢাকায় একটি অফিস স্থাপনের প্রস্তাবে নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে। তিনি বলেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কার্যালয়ের একটি শাখা ঢাকায় চালু করার বিষয়ে আলোচনা চলছিল এবং এর একটি খসড়া সমঝোতা স্মারক নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ফলকার টুর্কের কাছে পাঠানো হবে। প্রাথমিকভাবে তিন বছরের জন্য এ কার্যালয় স্থাপন করা হবে এবং দুই বছর পর বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে।
বিএনপির ইতিবাচক মনোভাব:
বিএনপি এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো অবস্থান না জানালেও, দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। তিনি বলেন, “আমরা তো জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রে সই করেছি। এখন তারা এখানে অফিস করলে সমস্যা কোথায়? গণতন্ত্র, নাগরিক অধিকার এগুলো রক্ষা করতে হলে তো মানবাধিকার রক্ষা করতে হবে।” তার মতে, মানবাধিকারের সঙ্গে ধর্মের কোনো বিরোধ নেই, বরং ধর্মীয় স্বাধীনতাও মানবাধিকারেরই অংশ।
মানবাধিকার কর্মীদের সমর্থন:
অন্তর্বর্তী সরকারের গুম কমিশনের সদস্য এবং মানবাধিকারকর্মী নূর খান মনে করেন, এই অফিস স্থাপন তাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল এবং এটি বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরতে সহায়তা করবে। তিনি সমালোচনার পরও এটিকে একটি ভালো পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন হকও মনে করেন, এই অফিস স্থাপিত হলে মানবাধিকার চর্চার একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠবে এবং সরকার মানবাধিকারের ব্যাপারে জবাবদিহিতা ও চাপে থাকবে, যা দেশের জন্য ভালো।
উল্লেখ্য, গত বছরের অক্টোবরে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক ঢাকা সফরে এসে ঢাকায় ওএইচসিআর অফিস খোলার বিষয়ে সরকারের সম্মতির বিষয়টি জানানোর পর থেকেই হেফাজতে ইসলাম প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিল। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন তখন কোনো সিদ্ধান্তের কথা অস্বীকার করলেও, জেনেভায় ৫৯তম মানবাধিকার পরিষদে ফলকার টুর্কের বক্তব্যে বাংলাদেশে তার দপ্তরের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করার তথ্য উঠে আসে।
প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ বলেছেন, উপদেষ্টা পরিষদ বাংলাদেশের স্বার্থ এবং মানবাধিকারের সব বিষয় বিবেচনা করেই এই নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। তিনি মনে করেন, "এখানে বিরোধিতার কোনো জায়গা নাই।" তিনি আরও যোগ করেন, "জাতিসংঘ সারা দুনিয়ায় মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করছে। বাংলাদেশে গত ১৬ বছর কীভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে তা তো সারা দুনিয়ার কাছে স্পষ্ট।"
সূত্র: ডয়চে ভেলে
Comments