
কুষ্টিয়া জেলার মহাসড়ক, আঞ্চলিক সড়ক, গ্রাম্য সড়কগুলোতে প্রতিদিনই ঘটে চলেছে ছোট বড় সড়ক দূর্ঘটনা। কোনভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না সড়ক দূর্ঘটনা। এতে একদিকে যেমন প্রাণহানীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে পঙ্গুত্ব বরন করছে দূর্ঘটনায় আহতরা। হতাহতের তালিকা হচ্ছে দীর্ঘ। চিকিৎসা সেবা নিতে সর্বশান্ত হচ্ছে নিহত ও আহতদের পরিবার।
একদিকে যেমন জেলার প্রায় প্রতিটি সড়কই প্রসারিত হয়েছে। গাড়ীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে পাল্লা দিয়ে। আইন প্রয়োগে দূর্বলতা বা চালকের খামখেয়ালীপনায় দূর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থদের পরিবারে নেমে আসছে কালো মেঘের ছায়া। দূর্ঘটনা রোধে সরকারি সংস্থাগুলো সভা, সেমিনার, চালকদের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করলেও কোনমতেই কাজে আসছেনা কোন কিছুই। কুষ্টিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনা যেন এক মহামারীতে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায় বা সোস্যাল মিডিয়ায় জেলার বিভিন্ন সড়কে দূর্ঘটনার খবর চোখে পড়ছে।
বিশিষ্টজনদের মতে, প্রশাসনিকভাবে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহন করা হলে পরিণতি আরো ভয়াবহ হতে পারে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকলকে ট্রাফিক আইন মেনে চলার জন্য আহবান জানানো হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম হলেও কুষ্টিয়া জেলার সড়কগুলো দিনের পর দিন সাধারণ মানুষের কাছে আতঙ্কে পরিণত হচ্ছে।
গত দেড় মাসে কুষ্টিয়া জেলায় ১২টি সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৮জন। এতে আহত হয়েছে অন্তত ৫০ হতে ৬০ জনেরও বেশী। এছাড়াও ছোট ছোট দূর্ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত। মানুষের পাশাপাশি পশুরাও বাদ যাচ্ছে না। গত বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে কুষ্টিয়া সদরের লাহিনী বটতলা এলাকায় কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী সড়কে দূর্ঘটনায় নাহিদুল ইসলাম রুপল (৩২) নামে এক ছাত্রদল নেতা নিহত হয়েছেন। ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে তিনি নিহত হন। নিহত নাহিদুল ইসলাম রুপল জেলা শহরের আবুল কাশেম লেনের আড়ুয়াপাড়ার আইয়ুব ইসলামের ছেলে। তিনি কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। নাহিদুল বিকেলে মোটরসাইকেলে করে কুমারখালী উপজেলা থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে পেছন থেকে বালুবোঝাই একটি ট্রাক তাঁকে ধাক্কা দেয়। এতে তিনি রাস্তায় ছিটকে পড়ে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনা¯’লেই মারা যান। এই ছাত্রদল নেতার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কুষ্টিয়ায় গত দেড় মাসে সড়ক দূর্ঘটনায় ৯ জন নিহতের ঘটনা ঘটে।
সড়ক দুর্ঘটনা যেন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেলার বিভিন্ন সড়কে একাধিক প্রাণঘাতী দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। বেপরোয়া গতি, অবৈধ যানবাহন, অদক্ষ চালক ও ট্রাফিক আইন অমান্য সব মিলিয়ে জেলার সড়কগুলো এখন আতঙ্কের নাম। গত দেড় মাসে কুষ্টিয়ায় ১২টি সড়ক দূর্ঘটনায় প্রান হারিয়েছেন ৮ জন। এর মধ্যে মোটরসাইকেল আরোহীই বেশি। যা সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে।
কুষ্টিয়া বিআরটিএ সূত্র জানায়, কুষ্টিয়ায় নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা রয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ৪ শত ৮টি। বিভিন্ন প্রকার এসব যানবাহন কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন সড়কে চলাচল করছে। যার মধ্যে মাঝারি মোটর সাইকেল ৭১ হাজার ১শত ৯৮টি, বড় মোটর সাইকেল ২৯হাজার ২শত ৩টি এবং ছোট মোটর সাইকেল ২হাজার ৬শত ৭৫ টি সহ মোট ১০ লাখ ৩হাজার ৭৬টি মোটর সাইকেল। অন্যান্য যানবাহনের মধ্যে মোটরসাইকেলই বেশি।
অপরদিকে কুষ্টিয়ার চৌড়হাস হাইওয়ে থানা সূত্রে জানা গেছে, কুষ্টিয়া জেলায় গত মে মাসে ৩টি সড়ক দূর্ঘটনা ঘটে। এই মাসে মারা যান ১জন। আহত হন ৪জন। এসব দূর্ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ১টি। অপরদিকে জুন মাসে সড়ক দূর্ঘটনা ঘটে ৯টি। আর এই ৯টি ঘটনায় প্রান হারান ৭ জন। প্রানে বেচে আহত হন ৭ জন। তবে জুন মাসে ৯টি সড়ক দূর্ঘটনা ঘটলেও মামলা হয়েছে মাত্র ২টি। আর প্রক্রিয়াধীন রয়েছে ১টি। এর মধ্যে মে মাসে ট্রাক দূর্ঘটনা ঘটে ৩টি, বাস ১টি, ট্রাক্টর ১টি বাইসাইকেল ১টি এবং মোটরসাইকেল দূর্ঘটনা ১টি।
গত ১৪ জুন কুষ্টিয়া-রাজবাড়ি মহাসড়কের মোড়াগাছা-হাসিমপুর এলাকায় ট্রাক ও মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন। ১৯ মে কুমারখালীতে ইটবাহী ট্রাক্টরের চাপায় মোটরসাইকেল আরোহী সুরুজ আহমেদ (২৩) নিহত হন। সড়ক দূর্ঘটনার সংখ্যা বিশ্লেষন করে দেখা গেছে বিভিন্ন যানবাহনের সাথে দূর্ঘটনায় পতিত হয়ে বেশির ভাগ প্রান হারিয়েছেন মোটর সাইকেল আরোহীরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কুষ্টিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে প্রধান কারণ হলো বেপরোয়া ও অনিয়ন্ত্রিত যান চলাচল, অবৈধ যানবাহন, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক, ট্রাফিক আইন না মানা, সড়কের খারাপ অবস্থা ও যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাব। প্রতিরোধে ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন, অবৈধ যানবাহন বন্ধ, চালকদের প্রশিক্ষণ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
কুষ্টিয়া সচেতন নাগরিক কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান লাকি বলেন, কুষ্টিয়ায় সড়ক দূর্ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে। এসব দূর্ঘটনার মধ্য্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। সচেতনতার অভাব এবং ট্রাফিক আইন মেনে না চলাই এর প্রধান কারণ বলে আমি মনে করি। এক্ষেত্রে জনগনকে যেমন সচেতন হতে হবে, তেমনি আইনশৃঙ্খলার কাজে নিয়োজিত সদস্যদের বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুষ্টিয়া ট্রাক মালিক গ্রুপের এক সদস্য বলেন, কুষ্টিয়ায় সড়কগুলোতে অনেক অবৈধ যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে গেছে। এসব যানবাহন চালকদের কোন ট্রেনিং নেই। মাঠে থেকে উঠে এসে অটো ইজিবাইক, নছিমন, করিমন চালাচ্ছে। তাদের হাইওয়ে সড়কে উঠার নিষেধ থাকলেও তারা মানছে না। এতে করে দূর্ঘটনা বাড়ছে। তাছাড়া এসব অবৈধ যানবাহন নিষিদ্ধে প্রশাসনের সাথে বারবার আলোচনায় বসলে তারা আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়ন করছে না অজ্ঞাত কারণে।
কুষ্টিয়া বিআরটিএ সার্কেল অফিসের সহকারি পরিচালক (ইঞ্জিঃ) মোঃ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সড়ক দূর্ঘটনার প্রধান কারণ হলো সচেতনতার অভাব। পাশাপাশি ট্রাফিক আইন সম্বন্ধে না জানা। এছাড়া সড়কগুলোতে যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে গেছে। সড়ক দূর্ঘটনা প্রতিরোধে আমরা বিভিন্ন প্রোগ্রাম করছি। সাধারন মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
কুষ্টিয়ার চৌড়হাস হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্য (ওসি) সৈয়দ আল মামুন বলেন, চৌড়হাস হাইওয়ে থানার অধিনে কুষ্টিয়া জেলার ছয়টি থানার মধ্যে ৯৫ কিলোমিটার রাস্তা কভার করি। আমরা সারা বছরই মামলা দিই। অবৈধ নছিমন, করিমন আটকসহ যত ধরনের কাজ আছে আমরা করি। আমাদের জনবল সংকটের কারণে পুরোপুরিভাবে সড়কে চলাচলরত যানবাহন নিয়ন্ত্রন করতে পারি না। তবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করি অবৈধ যানবাহন নিয়ন্ত্রন করার জন্য।
তিনি বলেন, সারা বছর যাই হোক, ঈদের সময় দূর্ঘটনা একটু বাড়ে। এর কারণ হলো, রাস্তাঘাটে যান চলাচলের পরিমান বেড়ে যায়। ঐ সময় সমস্ত দূরপাল্লার গাড়ীগুলো ডাবল টিপ খাটে। যাওয়ার সময় গাড়ীগুলো খালি যায় এবং আসার সময় ফুল প্যাসেঞ্জার নিয়ে দ্রুত চলে আসার কারণে দূর্ঘটনায় পতিত হয়। এছাড়া অতিরিক্ত গাড়ী চালায়। অপরদিকে আমাদের জেলা সড়কে দুই থেকে তিনটি বাক আছে। যার মধ্যে বহলবাড়িয়া একটি ব্যাকস্পট জায়গা। এই সব বাকে সিগনাল সহ বেশ কিছু প্রয়োজনীয় সংকেত বসাতে হবে। বেশি দূর্ঘটনা স্পট যেগুলো, সে জায়গা নিয়ে গবেষনা চলছে। আমাদের রাস্তায় যে পরিমান গাড়ী চলতে পারে, তার চেয়ে গাড়ীর পরিমান বেশি। এর মধ্যে ইজিবাইকের সংখ্যা বেশি, যা হাইওয়ে সড়কে চলাচল নিষেধ থাকলেও চলাচল করছে। আমরা তাদের সরাতে বা নিয়ন্ত্রন করতে পারছি না। অবৈধ নছিমন, করিমন, আলম সাধু , ভটভটিসহ অবৈধ যানবাহন ধরে আমরা মামলা দিচ্ছি। উপরের নির্দেশনা হলো অবৈধ যানবাহন মহাসড়কে উঠতে পারবে না। সেদিকে আমরা লক্ষ্য রাখি। তবে হানড্রেট পার্সেন্ট পারি না।
Comments