আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধে ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা, প্রত্যাবাসন ঝুঁকির মুখে: ক্রাইসিস গ্রুপ

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সক্রিয়তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) নতুন এশিয়া প্রতিবেদন 'বাংলাদেশ-মিয়ানমার: রোহিঙ্গা বিদ্রোহের ঝুঁকি'তে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি বুধবার সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হওয়ার কথা।
আইসিজি'র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাখাইনে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আরাকান আর্মির বিজয়ের পর রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো কক্সবাজারের আশ্রয়শিবির থেকে সদস্য সংগ্রহ জোরদার করেছে। বছরের পর বছর ধরে চলা অন্তর্দ্বন্দ্বের পর গত নভেম্বরে এই গোষ্ঠীগুলো আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। এই সমঝোতার পর শিবিরে সহিংসতা কমলেও, আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের লড়াইয়ে নামানোর জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে, কারণ আরাকান আর্মি মূলত রাজ্যের বৌদ্ধদের সমর্থন পাচ্ছে।
ক্রাইসিস গ্রুপ সতর্ক করে বলেছে যে, রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ক্রমবর্ধমান হামলা শুধু বাংলাদেশ সরকার ও আরাকান আর্মির মধ্যে শুরু হওয়া পরীক্ষামূলক আলোচনাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, বরং মিয়ানমারে রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাবও উস্কে দিতে পারে। এটি প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনাকে ব্যাহত করবে। বাংলাদেশের উচিত রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক ত্রাণ সহায়তা ও সীমান্ত বাণিজ্য জোরদার করা এবং একই সঙ্গে আশ্রয়শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব কমানো।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে আরাকান আর্মি যখন রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে অগ্রসর হতে শুরু করে, তখন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সংখ্যায় কম থাকা নিজেদের সৈন্যদের সঙ্গে মিলে লড়াইয়ের জন্য রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের মোতায়েন করার চেষ্টা করে। সামরিক বাহিনী জোরপূর্বক রোহিঙ্গা পুরুষদের মিলিশিয়া ইউনিটে নিয়োগ করে, স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহের জন্য সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে কাজ করে এবং রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করে। যদিও অনেক রোহিঙ্গা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার বিরোধিতা করেছিল, তবে আরাকান আর্মির উস্কানিমূলক বক্তব্য এবং উত্তর রাখাইনে তাদের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের অভিযোগ অনেক রোহিঙ্গাকে আরাকান আর্মিকে সামরিক বাহিনীর চেয়েও বড় হুমকি হিসেবে দেখতে প্রভাবিত করেছে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে মংডু টাউনশিপের পতনের আগেই রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে। নভেম্বরে তারা একটি 'সহাবস্থান' সমঝোতায় পৌঁছায় এবং পরের মাসেই আশ্রয়শিবিরে একটি বিশাল 'ঐক্য সমাবেশ' করে। ওই সমাবেশে তারা রোহিঙ্গাদের প্রতি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে উত্তর রাখাইন পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানায় এবং এই অভিযানকে 'অবিশ্বাসীদের' বিরুদ্ধে 'জিহাদ' হিসেবে অভিহিত করতে ধর্মীয় নেতাদের ব্যবহার করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠী ও আরাকান আর্মি উভয়ের সঙ্গেই দীর্ঘদিন ধরে সম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা গোষ্ঠীদের 'ঐক্যের' উদ্যোগকে সমর্থন দিয়েছে। যদিও তাদের উদ্দেশ্য শিবিরগুলোতে সহিংসতা কমানো, তবে মনে হচ্ছে, তারা আরাকান আর্মিকে রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করার একটি উপায় হিসেবে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করছে। এই সম্পৃক্ততা বাংলাদেশ সরকার ও আরাকান আর্মির মধ্যে শুরু হওয়া আলোচনার সম্ভাবনাকে হুমকির মুখে ফেলছে।
ক্রাইসিস গ্রুপ পরামর্শ দিয়েছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ আরও বাড়ানো এবং রাখাইন রাজ্যে অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য ও মানবিক সহায়তা বাড়াতে কাজ করা। এছাড়াও, ঢাকা ও তার নিরাপত্তা সংস্থাগুলোরও উচিত শিবিরে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব নিয়ন্ত্রণে জোর প্রচেষ্টা চালানো এবং নাগরিক সমাজের নেতৃত্ব গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি করা। আরাকান আর্মিরও উচিত রাখাইন রাজ্যের সব সম্প্রদায়ের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে শাসনকাজ চালাতে পারে তা প্রমাণ করা এবং রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনায় বসার ইচ্ছা প্রকাশ করা। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র তাদের বেশির ভাগ বৈদেশিক সহায়তা কমিয়ে দিচ্ছে, তাই অন্য আন্তর্জাতিক দাতাদের উচিত বাংলাদেশে আশ্রয়শিবিরে সহায়তা বাড়ানো।
Comments