
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলায় বকেয়া বেতন পরিশোধসহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করেছেন গোল্ডেন সন লিমিটেড কারখানার শ্রমিকেরা। রবিবার (৪ মে) সকাল থেকে উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের খোয়াজনগর এলাকায় সৈন্যারটেক নামক স্থানে অবস্থিত কারখানাটির শ্রমিকরা এই আন্দোলনে নামেন।
শ্রমিকদের অভিযোগ, কারখানা কর্তৃপক্ষ গত মার্চ ও এপ্রিল মাসের বেতন পরিশোধ করেনি। এছাড়াও, অনেক শ্রমিক রয়েছেন যারা কয়েক মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। বকেয়া বেতনের দাবিতে আজ সকাল ছয়টা থেকে শ্রমিকরা কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ শুরু করেন। দুপুর পর্যন্ত বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা কারখানার প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান করছিলেন।
এর আগে, সকাল ছয়টা থেকে প্রায় তিন ঘণ্টা শ্রমিকরা কারখানার সামনের সড়ক অবরোধ করে রাখেন। এ সময় সড়কে নারী শ্রমিকদের বসে থাকতে দেখা যায়। অবরোধের কারণে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। সকাল পৌনে নয়টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি দল ঘটনাস্থলে এসে শ্রমিকদের সড়ক থেকে সরিয়ে দিলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
পরে সকাল সাড়ে নয়টার দিকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কর্ণফুলী থানা পুলিশের একটি দল এসে শ্রমিকদের সাথে কথা বলেন এবং তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন।
কারখানার শ্রমিক মোহাম্মদ ইসমাঈল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমাদের গত দুই মাসের বেতন দেয়নি মালিকপক্ষ। আরও অনেক শ্রমিক আছে যারা এর চেয়েও বেশি সময় ধরে বেতন পাচ্ছে না। আমরা সারা মাস হাড়ভাঙা খাটুনি করি, অথচ পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে পারি না।”
তিনি আরও অভিযোগ করেন, “এখানে অনেক শ্রমিক বছরের পর বছর ধরে কাজ করছে, কিন্তু তাদের বেতন বাড়ানো হয় না। বেতন বৃদ্ধির কথা বললেই চাকরি হারানোর হুমকি দেওয়া হয়।”
আরেক শ্রমিক নজরুল ইসলাম বলেন, “আমরা কোনো মাসেই সময়মতো বেতন পাই না। মাসের শুরুতে বেতন চাইতে গেলে তারা বলে, ‘সময় হলে পাবে, না হলে চলে যাও।’ আমরা কোথায় যাব? কাজ করেও যদি বেতন না পাই, তাহলে পরিবারকে কী জবাব দেব?”
বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি দাবি তুলে ধরেছেন। তাদের প্রধান দাবিগুলো হলো, অবিলম্বে পূর্বের সকল বকেয়া বেতন পরিশোধ করা, শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি করা, প্রতি মাসের ১ থেকে ১০ তারিখের মধ্যে পূর্ণ বেতন পরিশোধ করা এবং কোনো শ্রমিককে ছাঁটাই করা হলে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তার প্রাপ্য টাকা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধ করা।
কারখানার নারী শ্রমিক সুফিয়া বেগম বলেন, “আমরা পেটের দায়ে এই কারখানায় কাজ করি। রমজান মাসেও তারা আমাদের উপর অনেক চাপ সৃষ্টি করেছে। আমরা ইফতার করার সময় পর্যন্ত পাইনি। সামান্য ভুল হলেই আইডি কার্ড কেড়ে নিয়ে চলে যেতে বলে। পরে কারখানার সামনে কান্নাকাটি করলে তারা আবার কাজে নেয়।”
একাধিক শ্রমিক জানান, তারা তাদের ন্যায্য পাওনা এবং অধিকার আদায়ের জন্যই আন্দোলনে নেমেছেন। কারখানা কর্তৃপক্ষ বা অন্য কারো ক্ষতি করা তাদের উদ্দেশ্য নয়।
কারখানার স্টোর সেকশনের একজন শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “কর্তৃপক্ষ কেন আমাদের বেতন দিতে পারছে না? কারখানার উৎপাদন তো বন্ধ নেই, বরং শ্রমিকদের দিয়ে প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টা করে বাধ্যতামূলক ওভারটাইম করানো হচ্ছে। তারপরও কেন আমাদের ন্যায্য বেতন সময়মতো দেওয়া হচ্ছে না?”
আন্দোলনে অংশ নেওয়া শ্রমিক সালাহউদ্দীন চাকরি হারানোর আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “আমরা পেটের দায়ে রাস্তায় নেমেছি। যারা আজ আন্দোলনে এসেছে, তাদের হয়তো চাকরি হারাতে হতে পারে। আমি প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করব, আমাদের ন্যায্য দাবি আদায়ে সহায়তা করুন এবং আমাদের চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।”
তবে, কারখানার মানবসম্পদ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. রুম্মান ইমাম জানান, শ্রমিকদের বকেয়া বেতন দ্রুত পরিশোধ করা হবে। প্রশাসনের সহযোগিতায় শ্রমিকরা কাজে ফিরেছেন এবং বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ শরীফ জানান, শ্রমিকদের সাথে কারখানা মালিকপক্ষের আলোচনা হয়েছে। শিগগিরই দুই মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধের আশ্বাসে শ্রমিকেরা তাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
উল্লেখ্য, গোল্ডেন সন লিমিটেড কারখানায় ২০টি আলাদা ইউনিটে কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করেন। শ্রমিকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই কারখানায় ইলেকট্রনিক ফ্যান, বিভিন্ন খেলনা এবং পারফিউমসহ নানা ধরনের পণ্য উৎপাদিত হয়।
Comments