হাওরের মাঠে নারী জাগরণ: পুরুষের সমান শ্রমেও মজুরিতে বৈষম্য

এক সময় সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার দিগন্তজোড়া ধানক্ষেতে পুরুষ শ্রমিকদের পদচারণায় মুখরিত থাকত। ধানকাটার মৌসুম এলেই দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসতেন হাজারো শ্রমিক, যাদের পরিচয় ছিল ‘ধান কাটার বেপারী’ নামে। কিন্তু কালের স্রোতে আজ সেই চিত্র অনেকটাই ফিকে। পুরুষ শ্রমিক সংকট এখন এখানকার কৃষকদের নিত্যসঙ্গী। তবে এই শূন্যস্থান পূরণ করছেন একদল নীরব যোদ্ধা – নারী কৃষি শ্রমিকেরা।
এক সময় যে সমাজে কৃষি কাজে নারীর আগমনকে অমঙ্গল হিসেবে দেখা হতো, সেই ধ্যানধারণা আজ জাদুঘরে ঠাঁই পেয়েছে। ‘মেয়েদের হাতে চাষাবাদের বরকত কমে যায়’ – এমন প্রবাদ এখন কেবলই অতীত স্মৃতি। অভাব আর সংসারের প্রয়োজনে জামালগঞ্জের নারীরা আজ পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাঠে নেমেছেন। পুরুষের সমান পরিশ্রম করেও তারা আর নিজেদের ‘অবলা’ ভাবতে নারাজ।
সারাদেশের মতো জামালগঞ্জেও এখন ধান কাটার উৎসব চলছে। তবে পুরুষ শ্রমিকের অভাব প্রকট। সরকার বালু উত্তোলন বন্ধ করে শ্রমিকদের কৃষিকাজে ফেরানোর চেষ্টা করলেও ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। ঠিক এই সময়েই ত্রাতা হয়ে এসেছেন নারীরা।
সাহেলা খাতুনের মতো অসংখ্য নারী জানান, স্বামীর একার রোজগারে সংসার চালানো কঠিন। তাই বাধ্য হয়েই ঘরের গণ্ডি পেরিয়ে পুরুষের সাথে মাঠে কাজ করতে এসেছেন তারা। শুধু ধান কাটা নয়, ধান লাগানো, শুকানো, সিদ্ধ করা – প্রায় প্রতিটি ধাপেই এখন নারীদের সরব উপস্থিতি।
তবে এই নীরব বিপ্লবের আড়ালে চাপা দীর্ঘশ্বাসও রয়েছে। পুরুষের সমান তালে কাজ করেও নারী শ্রমিকেরা পাচ্ছেন অর্ধেক মজুরি। যেখানে একজন পুরুষ শ্রমিক দৈনিক ৮০০ টাকা রোজগার করেন, সেখানে একজন নারী শ্রমিক একই পরিশ্রমে পান মাত্র ৫০০ টাকা।
হাজেরা বেগম, ফুলবানু, সেলিনা খাতুন, তুলন রানীর মতো অনেকেই এই বৈষম্যের শিকার। তারা জানান, বহুবার প্রতিবাদ করেও কোনো লাভ হয়নি। কৃষকদের একটাই কথা – এর বেশি দেওয়া তাদের সাধ্যে নেই।
শহরে নারী শ্রমিকদের জন্য শ্রম আইন থাকলেও গ্রামীণ কৃষি ক্ষেত্রে তা এখনও অধরা। ফলে ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এই কর্মীরা, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আজ কৃষিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কায়সার আহমেদ মনে করেন, পৃথিবীর বুকে কৃষিকাজ মূলত নারীদের হাত ধরেই সমৃদ্ধি লাভ করেছে। তাদের শ্রম ও ঘামেই আজকের এই বিপ্লব। তবে মজুরি বৈষম্য এখনও একটি বড় বাধা।
তিনি জানান, নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষিকাজে আরও বেশি আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা চলছে। সেই সাথে সরকারের কাছে গ্রামীণ নারী শ্রমিকদের শ্রম আইনের আওতায় এনে পুরুষের সমান মজুরি নিশ্চিত করার জোর দাবি জানিয়েছেন তিনি।
Comments