Image description

জীবনের বাঁকে বাঁকে গল্প, পথে-পথে দৃশ্য— সহজ অথবা জটিল বহুমাত্রিক গাণিতিক হিসাব। মেধা ছাড়া মুখস্থ নামতায় গণিত মেলে না, মেধার নাটাই ধরে ঘুড়ি উড়াতে হয়— চলতে হয় ধীরে, তবেই নির্মাণ হয় গল্প, গল্প থেকে ইতিহাস। গল্পটি সুরের, গান নিয়ে বেড়ে ওঠার। গল্পটি কৃষক থেকে ভিউনক্ষত্রের। সোদা মাটির গন্ধে যার দিন যায় গানে গানে, অভিনয়ে। কেন্দ্র থেকে দূরের গ্রামে। সুর বিলি করে রাস্তা-ঘাটে, সবুজ সমারোহে বাগানে। এক অদ্ভুত দিনযাপনের গল্প, বেদনাভরা বিষাদের গল্প হলেও আনন্দের শেষ নেই— কৃষকের ঘরে সুরের মূর্ছনা, অভিনয়ে ঠোঁটে আঞ্চলিক সংলাপ— এসবই নাতিদীর্ঘ আলাপন কিন্তু দীর্ঘ ইতিহাস। গল্পেটি ‘কৃষক থেকে ভিউনক্ষত্র’র।

সময়টা ২০১৭ সাল। বাদ্যযন্ত্রহীন টেবিল থাপড়ানোর তালে খালি গলায় গেয়েছিলেন ঈদের গান। ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ, কিন্তু এই অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়। ঈদ মানে সবার কাছে খুশি বা আনন্দের নয়। সমাজে অনেক মানুষ আছেন তারা ঈদে নতুন পোশাক তো দূরে থাকলো, তাদের ভাগ্যে সেমাইও জোটে না। আনন্দের দিনে করুণ দৃশ্যের নায়ক হয়ে অভিনয়-গান করেন মনির হোসেন। মনির হোসেন আসল না হলেও স্যোশাল মিডিয়ায় তাকে আলভি মনির নামে চেনে দর্শক-শ্রোতা। ‘আসলে ঈদের দিন আমার কেঁদেই কাটে দিন’—এ শিরোনামে গান গেয়ে অভিনয় করে ভাইরাল তালিকায় নাম লেখান। বাদ্যযন্ত্রহীন খালি গলা গাওয়া এ গানটি ভাইরাল হয়। এ ভাইরাল পরিবর্তন করে দেয় জীবনের মোড়। গান হূদয়ের গভীরে লালন করতেন কিন্তু বড় কোনো স্বপ্ন তার ছিলো না। স্বপ্ন না থাকলেও তার মেধা ছিলো, কণ্ঠে ছিলো জাদু। এই ভাইরাল স্মৃতি বহুদূরে যাওয়ার সাহস জোগায়। বর্তমান সময়ে কিছু তরুণ হূদয়ে ও কণ্ঠে ধারণ করছেন গান-অভিনয়। স্যোশাল মিডিয়া মাতিয়ে দূরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন আলভি মনির।

মানুষের জীবনে অনেকবার সকাল আসার দরকার নেই। আলোকিত একটি সকাল হাজার সকাল এনে দেয়। মনিরের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে। তার অজান্তে একটি সকাল এসেছিলো ২০১৭ সালে। মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ জমা করে করেন তার নামে হিসাবে। সেই থেকে গানের হূদয়ে হূদয় রেখে হাঁটছেন— দূরে, বহুদূরে যাওয়ার প্রত্যয়ে। মনির পাবনা জেলা ফরিদপুরের বিলচান্দক গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। কৃষক বাবা মো. মহির উদ্দিন আকন্দের চার সন্তানের মধ্যে বড় সন্তান মনির আলভি। মা মোছা. ময়না খাতুন, গৃহিণী। বাবা কৃষিকাজ করেন, বাবা সংসার সামলান। মনির কষ্ট করে জীবন নামের রেল গাড়িটি চালাচ্ছেন সুরে সুরে। মনিরের এই স্বপ্নের সারথী তার বাবা। তিনি কৃষিকাজ করে উপার্জন করে মনিরকে গান শেখার জন্য প্রতিদিন খরচ দিতেন। শুনে চোখে জল চলে আসে। এ বিষয়ে মনির বলেন— ‘বাবার পেশা কৃষি কাজ। পরিবারের বড় সন্তান আমি, নিজেও পরিবারের খোল রাখি। গানের পাশাপাশি পড়াশোনা ধরে রেখেছি, ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে পড়ছি। ইউটিউবে আসার  পেছনে আমার বাবার অবদান বেশি। তিনি অন্যের বাসায় কাজ করে সেই টাকা দিয়ে গান শিখতে পাঠিয়েছেন। টাকার অভাবে কোনো ভালো একাডেমিতে ভর্তি হতে পারিনি, তারপরেই ইউটিউবে চলে আসছি। এখনো আহামরি কিছু করতে পারিনি। তবে চেষ্টা করছি। আমি দর্শকের ভালোবাসায় অনেক দূরে যেতে চাই।’ মনির আরো বলেন— ‘একটি করুণ বিষয় শেয়ার করি। অনেক সময় বাবার কাছে টাকা থাকতো না। সে কারণে গানের আসরে যেতে চাইনি। বাবাকে চাপ দিতাম না, বেশ কষ্ট হতো বাবার জন্য। মনে হতো এতো কষ্টের টাকা দিয়ে আমি কেন গান শিখতে যাব, কিন্তু বাবা যাদের কাজ করেন, তাদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে আমাকে দিতেন। তখন মনে হতো আমার চেয়ে বাবার স্বপ্নই বড়। আনন্দে চোখ ভিজে যেত। একজন কৃষক গানকে কী পরিমাণ ভালো বাসরে এই কাজ করতে পারেন। তাই যে কোনোভাবেই বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। সেই থেকেই আমার জীবনের যুদ্ধ শুরু।’

রোমান্টিক গান করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন মনির। সবকিছুর অন্তরালে থাকে যুদ্ধের গল্প। যুদ্ধ জীবনের ঘনিষ্ঠ ছায়া। এই ছায়ায় প্রস্ফুটিত হয় কর্মফল। যে ফলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে মানুষের হূদয়ে থেকে হূদয়ে। মনিরও এমন গল্প আছে। গান নিয়ে বেড়ে ওঠার গল্প শুনতে চাইলে মনির বলেন— ‘আমার বাবা একজন সত্ কৃষক, তার অল্প আয়ে চলতো সংসার। কৃষক হলেও তার স্বপ্ন ছিলো আমি গান করি।  তার এই অনুপ্রেরণায় আমার গানে আসা। দুঃখ-কষ্ট বুকে নিয়েই গান করি। বুকে চাপা থাকে দুঃখ-কষ্ট, কণ্ঠে থাকে সুর, চোখে বড় হওয়ার স্বপ্ন। বাবার স্বপ্ন পূরণের অভিযানে আমি নেমেছি। দেখি দর্শকের ভালোবাসাসহ আল্লাহ কতদূর নিয়ে যায়। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।’ প্রতিটি মানুষে জীবনে যুদ্ধ আছে, থাকবে। যুদ্ধ করেই জীবনে জয় ছিনিয়ে আনতে হয়। মনিরও সেই স্বপ্ন দেখছেন। তার অর্জনও শুরু হয়েছে। এখন আর বাবার কাছ থেকে টাকা নিতে হয় না, উল্টো বাবাকে টাকা দেন। সংসার চালান তার উপার্জন করা টাকা দিয়ে। এর চেয়ে বড় ফসল হচ্ছে— মনির এখন সোশ্যাল মিডিয়ার নক্ষত্র। এ মেধাবী তরুণ শুধু গান-অভিনয় নিয়ে ব্যস্ত থাকেন না। ইতোমধ্যে তার বহুমাত্রিক মেধার পরিচয় দিয়েছেন। দেশের বিখ্যাত চার বক্তার কণ্ঠের সাথে মিল রেখে তাদের ওয়াজ করে ভাইরাল হন মনির। ওয়াজে ২৮ মিলিয়ন ভিউ হয়, তার গানজীবনে এটাই ছিলো সর্বোচ্চ ভিউ। তার পড়াশোনা চলমান। একজন তরুণ ১০ বছর বয়সে গান-অভিনয় করে ভাইরাল হন বিষয়টি সহজ না। এটি অবশ্যই মেধাবীর পরিচয় বহন করা। সময়ের কারণে সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া অন্য মাধ্যমে গান গাওয়া হচ্ছে না তার। গানের পাশাপাশি নাটকে কাজ করার ইচ্ছে আছে মনিরের। এ স্বপ্নও তার পূরণ হবে আশা করছি— জোর গলায় বলছি এর কারণ হচ্ছে— ‘দিন কেমন যাবে সকালের সূর্য দেখেই বলে দেয়া যায়।’— এই বাক্যটি মনিরের জন্য প্রযোজ্য। তার শুরুটাই সফলতা দিয়ে। এ বিষয়ে মনির বলেন— ‘আমি আশা করছি গানের মত নাটকেও ভালো করতে পারব। দর্শক-শ্রেতা পাশে থাকলে সফলতা আসবেই। আমার দিক থেকে সততার সাথে কাজ করে যাব, বাকিটা দর্শকের উপরে নির্ভর করবে।’

মনির আলভি মূলত রোমান্টিক গান করতে পছন্দ করেন। তার কণ্ঠেও এমন গানই ভালো যায়। মৌলিক গান করার বিষয়ে মনির বলেন— ‘একজন শিল্পীর পরিচয়ই হলো মৌলিক গান। শুধু কাভার সং করে নিজের পরিচয় ধরে রাখা যায় না, তাই সুযোগ হলে মৌলিক গান অবশ্যই করব।’

একজন শিল্পীর দায় শিল্পের কাছে। শিল্পকে ফাঁকি দিয়ে শিল্পী হওয়া যায় না- এই বিষয়টি তিনি অনুধাবন করেন। গানকে ভালো বাসতে-বাসতে একজন কণ্ঠশিল্পীর শ্রোতার প্রতি দায় বেড়ে যায়। এই দায় ও শ্রোতাদের ভালোবাসা নিয়েই মনিরের পথচলা। তার মুখে কোনো হতাশার গল্প নেই। তার জীবনে প্রত্যাশা, অর্জন নিয়ে জানতে চাইলে তিনি সহজ করে বলেন— ‘জীবনের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। সফলতা ব্যর্থতা নিয়েই মানুষের জীবন। আমি ব্যর্থতার হিসাব কষতে বসি না, জীবন আমাকে যা দিয়েছে আমি শুধু তার হিসাব রাখি আর তাতে আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছে বেড়ে যায়, জীবনের প্রতি অভিযোগ কমে যায়, জীবনটা সুন্দর মনে হয়।’

জীবনের উত্থান-পতনেও গান ছাড়েননি মনির। তিনি গানের মাঝে নিজের সুখ ও বিশ্বাস খুঁজে পান। তার স্বপ্ন শুধুই গান নিয়ে। লোকগান জীবনের কথা বলে— লোকগানকে ছড়িয়ে দিতে চান সর্বত্র। অর্জন নয়, একজন প্রকৃত শিল্পীকে কাজের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। বিশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি বুকে লালন করে এগিয়ে যাবে— এমন প্রত্যাশা মনিরের গানপাগল ভক্তদের। মনিরের জন্য দর্শক-শ্রোতাদের ভালোবাসা থাকলে আরো এগিয়ে যাবে। তার স্বপ্নযাত্রা শুভ হোক।

মানবকণ্ঠ/এসআরএস