Image description

বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের জোর-জবরদস্তি করে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া ও একটি অপমানজনক আয়োজনের মাধ্যমে পদত্যাগে বাধ্য করানোর ঘটনা ঘটছে। ইতোমধ্যে এ ধরনের অপতৎপরতায় অনেক শিক্ষককে একটি দুঃখজনক প্রক্রিয়ার মধ্যে তাদের দীর্ঘদিনের শিক্ষকজীবন থেকে তিরোহিত হতে হচ্ছে। যা সাদাচোখে দেখলে যে কেউ একে অন্যায়কর্ম হিসেবে সাব্যস্ত করবে। যারা এই ডামাডোলে ভিকটিম হয়েছেন এবং সম্ভাব্য তালিকায় আছেন তাদের কাছে কিন্তু পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতা হিসেবে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। 

যদি আমরা বিশ্বাস করি যে অপমান করে বের করে দেয়া শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা স্বৈরশাসক হাসিনার পতন চেয়েছেন তাহলে কী হবে বিষয়টা যে রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমরা গত প্রায় ১২-১৫ বছর ছিলাম সেখানে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকেই কোনো না কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে যেতে হয়েছে। অনেকের ক্ষেত্রে সেই অপ্রিয় বাস্তবতা নিত্যসঙ্গী হয়েছে। তাই, বৈষয়িকজীবন ও জীবিকায়নের ন্যূনতম নিশ্চয়তা পেয়ে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে বিভিন্ন মাত্রায় আপোষ করতে হয়েছে। আর সেই আপোষ, নৈতিকস্খলন অথবা অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে আদর্শ ত্যাগ এরূপ অনেক কারণ মানুষকে রাজনৈতিক ক্ষমতাসীনদের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। 

জেল-জুলুম-গুম-খুন এর যে ভয়াবহ বিস্তার ও এর ভয়াল থাবায় কতো মানুষের জীবন যে পথ হারিয়েছে, কতো মানুষ যে অন্যায় মামলার জালে জড়িয়ে বছরের পর বছর জেলে পচতে বাধ্য হচ্ছে, অনেকে জীবনহানির আশঙ্কায় দেশান্তরীও হয়েছেন। তাহলে, আপনি একজন শিক্ষককে কী শুধু বাহ্যিক দিকটা দেখেই মূল্যায়ন করবেন নাকি ভেতর-বাহির একটু খতিয়ে দেখবেন কোনটা একটা সময় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে যারা দুঃখ-দুর্দশায় পড়েছেন তারা হয়তো আইনি লড়াই করে নিজস্ব পদ-পদবি ফিরে পাবেন কিন্তু ততক্ষণে সংশ্লিষ্টদের জীবন কী আর ফিরে পাবে তাদেও সময়! সেই জায়গা থেকে যদি উদ্ভূত পরিস্থিতিকে বুঝতে চাই তাহলে কী আমরা বলবো যা চলছে তা ঠিক আমাদের অবশ্যই এর স্বরূপ সন্ধান করে মুক্তির উপায় খোঁজা উচিত। 

কিন্তু এসব ঘটনা কেন ঘটছে, এগুলো কী স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটছে, নাকি আয়োজিত, এসব কী পরিহার করা যেত না এবং সর্বোপরি এর স্থায়ী সমাধানই বা কী- এসব নানা প্রশ্ন এখন জনমনে চলছে। যে সকল ঘটনা পত্র-পত্রিকায় অথবা ইলেক্ট্রনিকস ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এসেছে তার কিছু কিছু বিষয়ে কর্তৃপক্ষ সমাধানের উদ্যোগ নিচ্ছে, কিন্তু অধিকাংশই এ মুহূর্তে অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছে এবং সন্দেহ নেই এর নেতিবাচক প্রভাব নিশ্চিতভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে শিক্ষা কার্যক্রম ও শিক্ষার্থীদের ভবিষৎ। যেমনটা আগেই বলেছি-আলোচ্য বিষয়ে উদ্ভূত যে সমস্যা তা যেমন বহুমুখী তেমনি এর কারণও বিবিধ। অর্থাৎ এর প্রকৃত কারণ, কেন এমন হচ্ছে, এরজন্য দায়ী কে বা কারা, সমাধানে কি কি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, উদ্যোগ যা নেয়া হয়েছিল সেগুলো কেন কাজ করেনি প্রভৃতি সবকিছুই এখন স্ববিস্তারে আলোচনার দাবি রাখে। তা না হলে আমাদের সেই একই ক্লীশে দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খেতে হবে। 

আলোচনায় প্রাসঙ্গিক মনে করে দুটো বিষয় খানিকটা পরিষ্কার করে নিলে সুবিধা হবে। সে হলো- শিক্ষক কে, শিক্ষকতা কী

এ শব্দবন্ধ দুটি যদি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে সাধারণভাবে পাওয়া যাবে, শিক্ষক হলেন তিনি- যিনি একজন শিক্ষার্থীর মনে জ্ঞানের ক্ষুধা তৈরি করেন করতে পারেন। অর্থাৎ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কতিপয় বিষয়ে শুধু পড়াবেন না, মুখস্থ করাবেন না- তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সবিস্তারে জানার তাগিদ সৃষ্টি করবেন। ওই জ্ঞান বা শিক্ষার সাথে জীবনযোগ কীভাবে করবে সেই প্রজ্ঞা তৈরি করবেন তিনি-ই শিক্ষক। 
এ অর্থে শিক্ষকের দায়িত্ব হলো- জ্ঞান আরোহণের সম্ভাব্য সকল উপায় উন্মোচন করা ও শিক্ষার্থীর জীবন চলার পথে জ্ঞান আরোহণ ও বাস্তবায়নের পথ বাতলে দেবেন। যাতে শিক্ষার্থীরা দেখতে পায় একটি অবারিত আলোর পথ, জীবনের বিশাল-বিপুল ব্যাপ্তি। 

পক্ষান্তরে, শিক্ষকতা হলো পেশা। শিক্ষকতায় ব্যক্তিশিক্ষকের বাইরে তার আরও অনেক বৈশিষ্ট্য দরকার যা হবে নৈতিকমানে উচ্চ। এ পেশায় ব্যবস্থাপনা আছে, মানুষকে সম্পদজ্ঞান করে তাকে গড়ে তোলার নানা ব্যবহারিক জ্ঞান এবং বহুপক্ষীয় অংশীজনের সম্পৃক্তায় সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ব্যাপৃত থাকাই হলো- শিক্ষকতা। শিক্ষকতা একটি আদর্শিক পেশা যা বিশেষ কিছু মূল্যবোধের দ্বারা পরিচালিত হয়। শিক্ষানুরাগ, জ্ঞান, দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ও দায়বদ্ধতা এমন অনেক নৈতিক মূল্যবোধের অধিকারী হিসেবে একজন শিক্ষক শেষ বিচারে তার শিক্ষার্থীর রোল মডেল। শিক্ষক সেকারণেই অনুকরণীয়, অনুস্মরণীয়। 

এমন মূল্যবোধ সমৃদ্ধ শিক্ষকের দেখা আমরা আমাদের সময় হামেশাই পেতাম। আমরা, আমাদের থেকে জ্যেষ্ঠ যারা তাদের অনেকের মুখে উচ্চ নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষকের কথা শুনেছি, শ্রদ্ধাজাগানিয়া অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়েছি। গল্প, কবিতা, নাটক ও চলচ্চিত্রে তেমন মাপের শিক্ষকের দেখা পাওয়া যেত। শুধু তাই নয়, শিক্ষকের মর্যাদা পরিবারে যেমন ছিল, তেমনি সমাজে ও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজেও শিক্ষকদের অংশগ্রহণ সমানভাবে নিশ্চিত করা হতো। শিক্ষকগণ সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় পুরাকালে ছিলেন অন্যতম অংশীজন। এখন সব বদলে গেছে। শিক্ষক আর শিক্ষকতায় নেই, যে সকল মূল্যবোধ একজন ধারণ করলে শিক্ষক হতে পারেন তেমন মানুষ খুব বেশি নেই। শিক্ষক এখন যে কেউ, শিক্ষক এখন রাজনীতির লাঠি ধরে নিজস্ব পদ-পদবি রক্ষা করতেই ব্যাকুল।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অমেধাবীরাই শিক্ষক হয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় জোচ্চুরি করে বাগানো সনদধারী ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদ কিনে শিক্ষকের চাকরি নিয়েছেন। যে বিষয়ে তার নিয়োগ সে বিষয়ে তার সর্বোচ্চ শিক্ষাগত অবস্থান কি, কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ থেকে তার লেখাপড়া এবং বিষয়ের ওপর তার দখল আছে কি না ইত্যাদি এখন শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আর বিবেচনায় নেয়া হয় না। 

গত প্রায় দুই-আড়াই দশক ধরে দেশে বিশেষ করে যারা মফস্বল শহরে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বা নিয়েছেন তাদের অধিকাংশকেই একটি দীর্ঘ অবৈধ-অন্যায্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এখানে অনেকেই আছেন যারা পৈত্রিক জমি দান করে, কেউ বা মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে আবার কেউ বা ক্ষমতাসীন দলের টিকিটে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। নিয়োগ পাওয়া অনেক শিক্ষক আবার মান্থলি পে-অর্ডার (এমপিও) পাওয়ার পথে হাঁটতে হাঁটতে জুতো ক্ষয় করে হয়রান। কিন্তু শিক্ষক হওয়ার জন্য প্রাথমিক এবং প্রধান বিষয় যেটি অর্থাৎ শিক্ষাগত যোগ্যতা, মানুষ হিসেবে তার দৃষ্টিভঙ্গি, এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা কেমন এই বিষয়গুলোও তো শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে খুব একটা দেখা হয়নি। সরকারি শিক্ষক নিয়োগে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে তাদের নিয়োগ দেয় বলে সেখানে অতটা দুর্গতি হয়নি। কিন্তু বেসরকারি পর্যায়ে নিয়োগে যা হয়েছে তা যে কোনো বিবেকবান মানুষকে আশঙ্কিত করবে। 

ওদিকে সরকারি নিয়োগে শিক্ষকদের মান ও পেশাগত দক্ষতা নিয়েও খুব একটা আশাবাদী হওয়ারও কারণ নেই। সেখানেও প্রশ্নফাঁস, দলীয়করণ ও ঘুষের যে মচ্ছপ চলেছে সেটা নজিরবিহীন, অকল্পনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে বা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় বিভিন্ন পদ-পদবি পাওয়া নিয়ে যা হয়েছে সেটা আর যাই হোক যোগ্যতার ভিত্তিতে হয় নাই। এটা করা হয়েছে শিক্ষকদের রঙ (নীল, সাদা,...) দেখে। কার রঙ কি, কে কোন রঙে রঙিন সেটাই মূল বিবেচ্য হিসেবে কাজ করে। সে কারণে শিক্ষকরা তাদের প্রধান দায়িত্ব পাশে সরিয়ে রেখে রাজনৈতিতেই বেশি সক্রিয় হয়। 

একজন রাজনৈতিক বিকৃত টাউট আর ধান্দাবাজের সাথে অনেক অনেক শিক্ষককে আমি চিনি তাদের পার্থক্য করতে পারি না। শিক্ষক অথবা শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালন এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দুটোর মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য ও স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। দুটো দুই বিষয়। তাই এ অতি প্রয়োজনীয় দুটি গুরুত্বপূর্ণ ডিসিপ্লিন যখন স্ব-স্ব দায়িত্ব ও সীমারেখা ভুলে যায় তখন ওই জরুরি বিভাজন রেখাটি মিলিয়ে যায়। যা কোনোভাবেই সুফল আনতে পারে না। আর এ প্রবণতা শুধু যে শিক্ষকদের মধ্যে দেখা যেত তা-তো নয়। এই দুষ্টচক্রে আটকা পড়েছিল প্রায় সকল পেশাজীবী, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিককর্মী সবাই। এ অপ-আয়োজন থেকে বিশালবপু আমলাতন্ত্রের একটি কোনোও বাদ যায়নি। সবাই অবৈধ ক্ষমতায় মদমত্ত হয়ে কেবল ভয়াবহ ত্রাসের ছড়িই ঘুড়িয়েছে। মানুষকে বুঝতে চায়নি, শিক্ষার্থীর মনস্তত্ত্ব পাঠ করতে ব্যর্থ হয়েছে সবাই। 

মহামতি কার্ল মার্কস-এর মতে পুঁজিবাদী সমাজে ক্ষমতাকাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে মূলত পুঁজি, অর্থাৎ টাকা। অর্থ থাকলে ব্যক্তিমানুষ বা সমষ্টি যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারে। আর এমন অবস্থা যাখন দীর্ঘদিন চলতে থাকে তখন একে একে ভেঙে পড়তে থাকে সমাজ টিকে থাকার মেরুদণ্ডসম মূল্যবোধগুলো। অর্থ-বিত্তের মালিক হতে তখন ব্যক্তিমানুষ শর্টকার্ট আর অবৈধ পথ বেছে নিতে দ্বিধা করে না। আর সেখান থেকে শিক্ষকরাও মুক্ত থাকতে পারেননি! তারা প্রায় প্রত্যেকে শিক্ষকতার মহত্তম আদর্শের প্রদীপটিকে গলাটিপে নিভিয়ে দেয়। আপোষ করে পুঁজিপতি-বেনিয়া-মুৎসুদ্দির সাথে। তথাকথিত ক্ষমতার ডানা লাগিয়ে তারাও উড়ে উড়ে ধেয়ে যায় অপরাজনীতি আর অপশক্তির আঁতুরঘরে। 

গত প্রায় দুই দশকে রাজনীতিতে শিক্ষকরা যেভাবে যুক্ত হয়েছে সেটা অকল্পনীয়। পুরাকালে এমনটা দেখা যেত না। সেটা শুধু শিক্ষক নন বরং অন্যান্য সৃজনশীল পেশা যেমন- সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, নাটক এগুলোতে যারা যুক্ত থাকতেন তারা সেভাবে রাজনৈতিক কার্যক্রমে ভিজিবল হতো না। স্থানীয় সাংসদগণ যারা এমপিতন্ত্রের ধ্বজাধারী হিসেবে এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করে বসে আর ওই কৃত্রিম ক্ষমতাকাঠামো ধরে রাখতে তাকে তৈরি করতে হয় দাসানুদাস অনুগত বাহিনী। আর এই ক্ষমতাদুর্গ তৈরি ও চালিয়ে নেয়ার জন্য শিক্ষকদের যুক্ত করা হয়। যাতে তাদের আদর্শ, পেশাগত মর্যাদা ও ইমেজকে রাজনীতিতে ক্যাশ করা যায়। 

সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে এমপির নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণের কারণে শিক্ষকরা তাদের চাকরি প্রাপ্তি, এমপিও নিশ্চিত করা এবং চাকরি বাঁচিয়ে রাখতে ন্যূনতম খড়কুটো যা পায় তাই আঁকড়ে ধরার মানসে তথাকথিত ক্ষমতার মূলসড়কে এসে দাঁড়াতে চায়। প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে অধ্যক্ষ অথবা প্রধান শিক্ষক তারা ওই প্রতিষ্ঠান চৌহদ্দির মধ্যে বনে যায় সর্বেসর্বা। ক্ষমতাসীন রাজনীতির মেইন সুইচ থেকে পাওয়ার নিয়ে তারা স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানে তাণ্ডব চালাতে থাকে। শিক্ষক নিয়োগ, বেশি বেশি টিউশন ফি আদায়, শিক্ষা-সংক্রান্ত নানা অদ্ভুত নামে আদায় করা অর্থ অনেকটা নির্বিচারে নিজে গলাধকরণ করে। কতিপয় শিক্ষক আর পরজীবী ব্যবস্থাপনা সদস্যকে হাতে রেখে তারা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর দুর্নীতি চালিয়ে যায়। 

আমরা সে সময়টায় সাম্যবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমে রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে মার্কসবাদের দীক্ষা নিচ্ছি, আমরা গ্রন্থকীটের মতো নাক ডুবিয়ে বই পড়িনি ঠিকই কিন্তু আমাদেরকে দৈনন্দিন জীবনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি আরও অনেক কিছু করতে হতো। আমাদের তখন নানা এক্সট্রা কারিকুলার একটিভিটিতে যোগ দেয়ার সুযোগ অবারিত ছিল। তৎকালীন সদ্য প্রতিষ্ঠিত একমাত্র মহাবিদ্যালয়ের সর্বজনাব অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও শিক্ষকমণ্ডলী এলাকার সব তরুণ-তরুণীদের যেন দুহাত মেলে আহ্বান করেছিল- তোমরা আসো, এখান থেকে শিক্ষা, ক্রীড়া, তারুণ্য, রাজনীতি, সৃজনশীল সংস্কৃতির আবির মেখে জীবনকে চুটিয়ে উপভোগ কর। আজ আজকাল মাঠে নেই খেলাধুলা, কেন্দ্র থেকে তৃণমূল কোথাও ক্রীড়া টুর্নামেন্টগুলো আয়োজিত হয় না, ক্রীড়া সংগঠনগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, শিল্পকলায় পৃষ্ঠপোষকতা নেই, সরকারি অডিটরিয়াম বছরের বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকে। 

ইত্যবৎসরে যদি কোনো অনুষ্ঠান হয়ও সেগুলো ইঁদুরমারা কর্মসূচির মতো কিছু একটা বৈ কিছু নয়। নাই নাট্যগোষ্ঠী, শিশু সংগঠন, নাই কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কচর্চার প্লাটফর্ম! এতোসব কিছু উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে আমি মূলত নিন্মোক্ত তিনটি বিষয়ে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছি- এক. শিক্ষামানের পড়তি গ্রাফটির সূচনা কিন্তু মানহীন শিক্ষক নিয়োগের মধ্যেই। কারণ, শিক্ষকমণ্ডলী যদি চায়, যদি শিক্ষাব্যবস্থাপনা আন্তরিক ও বিদ্যোৎসাহী হয় তাহলে তারা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারবেন। এটা না করতে পারলে শিক্ষা নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। দুই. “শিক্ষকদের সম্মান বিষয়টি শর্তনিরপেক্ষ নয়! ওটা অনেক কিছুর একটি সামষ্টিক ইতিবাচক আধেয়। শিক্ষক, শিক্ষাগুরুর সম্মান এগুলো কোনো আপ্তবাক্য নয়। শিক্ষক ও সম্মান সমাসবদ্ধ হয়ে কী হয় শিক্ষকের সম্মান- তার মানে হলো একজন শিক্ষক এমন হবেন যাকে সকল শিক্ষার্থী ভক্তি সম্মান করবেন। আর চলতি বাস্তবতায় সেটিতে যখন ব্যত্যয় দেখা যাচ্ছে তাহলে আপনাকে ধরে নিতে হবে ডাল মে কুচ কালা হ্যায়। 

এখন তাহলে আসেন, দেখি একজন শিক্ষার্থী কেন কোনো একজন শিক্ষককে সম্মান করবে। কারণ ছাড়া যেমন কার্য হয় না, তেমনি সম্মানের যোগ্য বা শিক্ষার্থীর জীবনে শিক্ষক ভ্যালু এ্যাড করতে না পারলে তারা খালি খালি সম্মান দেখাবে না। আপনাকে শিক্ষার্থীদের জন্য উন্নত, প্রগতিশীল, সৃজনশীলতা গুণসম্মত জীবনচরিত্র উপস্থাপন করতে হবে। একজন শিক্ষার্থীকে আপনার নিকট আসার অনুপ্রেরণা পেতে হবে। অথচ, আমরা দেখছি- উল্টোচিত্র! শিক্ষার্থীরা দেখছে শিক্ষক ক্লাস ফাঁকি দিচ্ছে, জাগ্রত সময়ের প্রায় পুরোটা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে থাকছে, ঘুষ নিচ্ছে, বাড়তি আয়ের আশায় শিক্ষার্থীদের সাথে ছল করছে তখন শিক্ষার্থীরা কী করবে তারা কীসের মাথা খেয়ে ওই শিক্ষক বা শিক্ষকদেরকে সম্মান দেখাবে দেখাবে না। তিন. আর তৃতীয়টি হলো- এ বিষয়ে নতুন কী বাস্তবতা তৈরি করা যায় বা প্রত্যাশাটা কি সেটা। 

প্রথমেই শিখন পদ্ধতি, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা এবং মানসম্মত শিক্ষা-পরিবেশ ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার করতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি যা আছে তাই থাকবে। বরং আশঙ্কা আছে আরো অবনতি হওয়ার। আমরা ব্যক্তিজীবনে যেমন অগ্রাধিকার করে জীবনযাপনকে করি তেমনি সমাজ বা চূড়ান্ত বিচারে রাষ্ট্রও তাই করে। কারণ দুটোই এক অর্থে জীবন্ত সত্ত্বা। আপনি ব্যক্তিজীবনে এক নম্বর অগ্রাধিকারকে যেমন এক নম্বরে বাস্তবায়ন করেন তেমনি রাষ্ট্রও তাই করে। 

তাই, নাগরিক হিসেবে আমাদের সবার পক্ষ থেকেই শিক্ষাকে এক ও অন্যতম অগ্রাধিকার করার দাবি তুলতে হবে। এটা শুধু রাষ্ট্র করবে, এনজিও-রা দাবি তুলবে বা সংবাদপত্রে খবর বেরুবে এমনটা মনে করলে হবে না। মানসম্মত শিক্ষা ও সেই শিক্ষার বাহক হিসেবে শিক্ষকদের নৈতিকমান নিশ্চিতে ছাত্র-শিক্ষক ও দেশপ্রেমিক মানুষ সবাইকে একসাথে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই। 

লেখক: অধিকারভিত্তিক উন্নয়ন সন্ধানী।


মানবকণ্ঠ/এফআই