Image description

১৯৬১ সালে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে ভারত। শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। এর মাঝে ১৯৭২ সালে যৌথ নদী কমিশন গঠন এবং ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশ সিদ্ধান্ত নেয় যে, শুষ্ক মৌসুমের পানি ভাগাভাগির পর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে কোনো চুক্তিতে উপনীত হওয়ার আগে ফারাক্কা বাঁধ চালু করা হবে না। কিন্তু ভারত বাঁধের ফিডার ক্যানাল পরীক্ষা করার কথা বলে এবং বাংলাদেশ সরল বিশ্বাসে অনুমতি দেয়। কিন্তু ভারত সরল বিশ্বাসের অমর্যাদা করে বাঁধের পরীক্ষামূলক চালু এখনও অযৌক্তিভাবে চালু অব্যাহত রেখেছে। ফলে শুষ্ক কিংবা ভরা মৌসুম কোনো সময়েই পানির ন্যায্যতা পায়নি বাংলাদেশ। এর পর দফায় দফায় অনেক আলোচনা হলেও পানি বণ্টন চুক্তি সফল হয়নি। পরিশেষে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি হয়। সেটিও কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে তা আমাদের সকলের অজানা নয়। কিন্তু ১৯৯৮ সালে ভারত তিস্তার উজানে নির্মাণ করে গজলডোবা বাঁধ। ফলে ফারাক্কার মতই আরেক অন্যায় আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ভারত। ফলে সংকটে পড়ে বাংলাদেশ।

আসুন এবারে একটু আন্তর্জাতিক পানি বণ্টন আইনের বিষয়ে আলোকপাত করা যাক। আন্তর্জাতিক পানি বণ্টন প্রস্তবনাটি (Convention on the Law of the Non-Navigational Uses of International Watercourses-1997) প্রাথমিকভাবে জাতিসংঘে উত্থাপিত হয় ১৯৯৭ সালে। ওই সময়ে ১০৩টি দেশ নীতিগত সিদ্ধান্তে মতপ্রকাশ করে, ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকে ভারতসহ ২৭টি দেশ। কিন্তু ২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট আইনে পরিণত হয়। মজার বিষয় হলো প্রস্তাবনা ও স্বাক্ষর করার বহু বছর পার হলেও আজ অবধিও স্বাক্ষর বা নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা থেকে দূরে আছে বাংলাদেশ। প্রতিবেশী দেশ ভারতও স্বাক্ষর করেনি; তাই আইন মানা তাদের জন্যও জরুরি না। অথচ সমুদ্রবন্দর থাকা ও ভাটির দেশ হিসাবে বাংলাদেশের জন্য এ আইন খুব জরুরি ও তাত্পর্যপূর্ণ ছিল। জিম্বাবুয়ে ও সুদানের মতো দেশ ল্যান্ড লক কান্ট্রি হওয়ার পরেও তারা স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ আইনে স্বাক্ষর করেনি। ফলে ভারতকে আইন মানাতেও বাধ্য করতে পারবে না বাংলাদেশ। তাই এই হিসাবেও সংকটে রয়েছে বাংলাদেশ।

২০১৪ সালে ভারতের এই আধিপত্য ঠেকানোর জন্য তিস্তা বহুমুখী ব্যারাজ ও গঙ্গা নদীতে বাংলাদেশের অংশে ব্যারাজ নির্মাণ করার আগ্রহ প্রকাশ করে চীন। যদিও ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পর বাংলাদেশে গঙ্গা বাঁধ পরিকল্পনা শুরু হয় ষাটের দশক থেকেই। চীন ইতোমধ্যে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণের জন্য একশো কোটি ডলার ব্যয়ের পরিকল্পনাও করেছে। কিন্তু ভারতের আপত্তিতে তিস্তা ও গঙ্গা প্রকল্পে বাংলাদেশ চীনের সে প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। কথিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেও চীনা রাষ্ট্রদূত তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণের আশা প্রকাশ করেছেন। তবে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসলেও তেমন কোনো আগ্রহের কথা শোনা যায়নি।

ভারতের উজানে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের কারণে তিস্তা প্রায় শুকিয়ে যায়, বর্ষাকালে যখন নদী উপচে পড়ে, তখন বাংলাদেশে ঘন ঘন বন্যা দেখা দেয়। কেননা ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রায়ই পানির চাপ বন্ধ করার জন্য গাজলডোবা ব্যারাজে ফ্লাডগেট খুলে দেয়। তাই তিস্তার মতো খরস্রোতা নদীতে ব্যারাজ নির্মাণ করা হলে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা হবে বলে মনে করি। এক্ষেত্রে কিছু পরিকল্পনাও করা জরুরি। যেমন ব্যারাজ এলাকায় তিস্তার প্রস্থ কমিয়ে আনতে হবে। ব্যারাজের ডাউনে রিভার ট্রেইন (নদী শাসন) করে একে একটি নির্দিষ্ট আকৃতিতে আনতে হবে। ড্রেজিং করে নদীর গভীরতা বাড়ানোর পাশাপাশি করতে হবে রিভেটমেন্ট বা পাড় সংস্কার। ফলে তিস্তার পাড়ের ভূমিও পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে। এতে উপকৃত হবে ওই অঞ্চলের মানুষ। এছাড়াও এমব্যাংকমেন্ট বাঁধ নির্মাণ করে নদী তীরের অধিবাসীদের বন্যা থেকে রক্ষা করাও সম্ভব হবে। আবার গঙ্গা ব্যারাজ অপেক্ষাকৃত সমতলে অবস্থিত হওয়ায় এমব্যাংকমেন্ট তৈরি করে পানি জমিয়ে ভারতকে বর্ষায় পানিতে ডোবানোর হুমকিও দেয়া যাবে। এছাড়াও গঙ্গা বাঁধ থেকে জলবিদ্যুত্ উত্পাদনও সম্ভব হবে।

এতো গেল মহাপরিকল্পনার ইতিবাচক এক অংশ! সমস্যা আরও আছে, যেমন গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মতো দেশের আগ্রহ বেশ জোরেশোরে প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি নিয়ে অনেক জোর কথাবার্তা হয়েছে। সেসব কারণে এরকম একটা আলোচনা তৈরি হয়েছিল যে বাংলাদেশ পশ্চিমের দিকে কিছুটা ঝুঁকছে কিনা। এ ভাবনাটা হয়ত ভারতেরই বেশি থাকার কথা। ভাবনাটা আরও বেড়ে গেছে যখন গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান হিসাবে দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ইউনূস সরকার আসার পরে ভারত কিছুটা হলেও ভূরাজনীতির আছে বলে আমি মনে করি। ভারত নিজ থেকে স্বীকার না করলেও সমপ্রতি তাদের কিছু মিডিয়ার বাংলাদেশ বিদ্বেষী মিথ্যাচারে মোটামুটি আন্দাজ করাই যাচ্ছে। তাদের ভয়টা বেশি ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে। কেননা ড. ইউনূসের শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবনের কিছুটা সময় যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়েছেন। তারা ধারণা করছে যে এই কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বেড়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবিরের একটা বক্তব্যের কথা মনে পড়ে।

তিনি একবার এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন, বাংলাদেশের অনেক প্রয়োজন আছে যেগুলোর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বা অনেক পশ্চিমা দেশ সহায়তা করতে পারে না। সেরকম ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি চীনের কাছ থেকে সহায়তা পায় তাহলে তারা খুশি হবে না, কিন্তু আপত্তিও করবে না। তবে যাইহোক, ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি কৌশলে বাংলাদেশের স্বার্থে কাজ করবেন বলে আমরা দৃঢ় বিশ্বাস করি। যাতে সাপও না মরে লাঠিও না ভাঙে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ভারতের আধিপত্য ঠেকাতে চীন চাইবে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে। সেক্ষেত্রে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণে বাংলাদেশ সায় দিলে চীন খুব সহজেই রাজি হবে বলে মনে করি। এর আগেও তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালে চীনে গিয়ে সাহায্য চেয়েছিলেন কক্সবাজার উপকূলে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য। চীন বেশ আগ্রহের সঙ্গেই এই প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছিল। ধারণা করা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের চাপে শেষ পর্যন্ত ওই প্রকল্পটি থেকে পিছিয়ে এসে জাপানের সহায়তায় মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরির প্রকল্পে হাত দেয় বাংলাদেশ। তবে এবারে ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। ভারতের বহুদিনের মিত্র হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি বরাবরই শান্তিপ্রিয় ও সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য বদ্ধপরিকর। তাই বাংলাদেশ চাইবে কৌশলে সকলের একক আধিপত্য পরিহার করে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। এক্ষেত্রে কারও সাথে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে পরস্পরের প্রতি সহনশীলতার নীতি অবলম্বন করে কী জন্য বা কী কারণে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি সেটি তৃতীয় পক্ষকে বুঝাতে সক্ষমত হওয়াটাও জরুরি। রাষ্ট্র সংস্কারে যা যা জরুরি করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ তা এই সরকারেরই করতে হবে। আন্তর্জাতিক পানি বণ্টন আইনে স্বাক্ষর করার এখনই সময়। কারও হুমকি পাত্তা না দিয়ে তিস্তা ও গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণে চীনের প্রস্তাবে সাড়া দেয়ার এখনই সময়। জনগণের স্বার্থে কারও সাথে কোনো আপস নয়। আশা করছি ইউনূস সরকার এদিকেও শতভাগ সফল হবে। ছাত্ররা যে উদ্দেশ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করেছে, যে বাংলাদেশ দেখতে চায়; তাদের প্রত্যাশার প্রদীপ যেন সেভাবে জ্বলতে থাকে।

লেখক: সাংবাদিক

মানবকণ্ঠ/এসআরএস