Image description

জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবিতে জামায়াতে ইসলামী, চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস এবং খেলাফত মজলিসসহ চারটি দল যুগপৎ আন্দোলনে নেমেছে। আগামী নির্বাচনের আগে সাংবিধানিক সংস্কার কার্যকর করার মাধ্যমে সরকার ও বিএনপিকে চাপে রাখাই এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। রাজনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, এই আন্দোলন ভবিষ্যতে নির্বাচনী জোটে রূপ নিতে পারে।

কর্মসূচি ঘোষণা

গত সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫) পৃথক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন পাঁচ দফা, এবং খেলাফত মজলিস ছয় দফা দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করে। এর আগে রোববার মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসও পাঁচ দফা দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। দলগুলোর দাবির মধ্যে রয়েছে: ১) জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন; ২) সংসদের উভয় কক্ষে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতি চালু; ৩) গণহত্যার বিচার; ৪) নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ (লেভেল প্লেইং ফিল্ড) ৫) জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধকরণ।

ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায়, ১৯ সেপ্টেম্বর বিভাগীয় শহরে এবং ২৬ সেপ্টেম্বর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। তবে, একই দিনে একই কর্মসূচি হলেও দলগুলো আলাদা মঞ্চে এগুলো পালন করবে।

যুগপৎ আন্দোলনে অন্য দলের অংশগ্রহণ

রাজনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, নেজামে ইসলাম পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল এই যুগপৎ আন্দোলনে যোগ দিতে পারে। গত শনিবার অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিসের পাশাপাশি এনসিপি, এবি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদও অংশ নিয়েছিল। এই তিন দল জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন, নির্বাচনে লেভেল প্লেইং ফিল্ড এবং জাতীয় পার্টিসহ আওয়ামী লীগের সহযোগী দলগুলোর কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে একমত। তবে, এনসিপি ও এবি পার্টি শুধু সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর চায়, উভয় কক্ষে নয়। একইভাবে, দুই খেলাফত মজলিসও উচ্চকক্ষে পিআরের পক্ষে।

এনসিপি ও এবি পার্টি জানিয়েছে, ডানপন্থি ‘ট্যাগ’ এড়াতে তারা এখনই ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে জোট বা যুগপৎ আন্দোলনে যোগ দিতে চায় না। তবে, নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর সমঝোতার সম্ভাবনা রয়েছে। বিএনপির শরিক গণঅধিকার পরিষদ তাদের বর্তমান অবস্থানে থাকতে চায়, তবে তারাও জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি এবং নির্বাচনের আগে বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে। নুরুল হক নুরের নেতৃত্বাধীন এই দলটি জানিয়েছে, তাদের দাবি জামায়াতের কাছাকাছি হলেও এখনই জোট গঠন করবে না।

জুলাই সনদ নিয়ে মতবিরোধ

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদে ৮৪টি সংস্কারের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে, যার মধ্যে ১১টিতে বিভিন্ন দল নোট অব ডিসেন্ট জমা দিয়েছে। বিএনপি উচ্চকক্ষে পিআর, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকা রহিতকরণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন পদ্ধতি, কমিটির মাধ্যমে দুদকের নিয়োগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্তে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, ক্ষমতায় গেলে এই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করবে না।

জামায়াত গভর্নর নিয়োগ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তসহ কয়েকটিতে নোট অব ডিসেন্ট দিলেও সনদের সবকটি সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন চায়। ইসলামী আন্দোলন রাষ্ট্রপতির নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, তবে তারাও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের পক্ষে।

বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দ্বন্দ্ব

জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের মতে, বিশেষ সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। তারা চায়, সংসদে সনদ অনুমোদনের পর তা গণভোটে গৃহীত হোক, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এটি বাতিল করতে না পারে। অন্যদিকে, বিএনপি মনে করে, সাংবিধানিক সংস্কার আগামী সংসদে দুই বছরের মধ্যে করা হবে।

গত রোববার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপস্থিতিতে তৃতীয় দফার সংলাপে কোনো দলই বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে নিজ অবস্থান থেকে সরেনি। কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেল সাংবিধানিক আদেশ বা গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে মত দিলেও সরকার এখন রাজনৈতিক সমঝোতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। কমিশনের মেয়াদ শেষ হলেও আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বিএনপির ওপর চাপ তৈরির কৌশল

জামায়াতসহ যুগপৎ আন্দোলনের দলগুলোর নেতারা জানিয়েছেন, বিএনপি অভ্যুত্থানের পর অন্য দলের মতামতকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। তারা মনে করে, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সংবিধান সংস্কার করবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। নেতারা বলছেন, উচ্চকক্ষে পিআর মানতে বাধ্য করতেই উভয় কক্ষে পিআরের দাবি তুলে চাপ তৈরি করা হচ্ছে। বিএনপি উচ্চকক্ষে পিআর মেনে নিলে নিম্নকক্ষে পিআরের দাবি বাদ দেওয়া হতে পারে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “দলগুলো নির্বাচনী কৌশল হিসেবে যুগপৎ আন্দোলনে নেমেছে। আন্দোলন করা তাদের রাজনৈতিক অধিকার।” তবে, সনদ নিয়ে চলমান আলোচনার মধ্যে এই আন্দোলনকে তিনি ‘দ্বিচারিতা’ বলে মন্তব্য করেছেন। জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিএনপি কোনো দলকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নয়। এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

জামায়াতের অবস্থান

রাজধানীর মগবাজারে আল-ফালাহ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, “জুলাই অভ্যুত্থানকে সফল করতেই এই আন্দোলন। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হতেই হবে।” তিনি দাবি করেন, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পদত্যাগে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। জনগণের অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, যার বৈধতার উৎস সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭। তিনি বলেন, “আইনগত ভিত্তি ছাড়া অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে।”

ডা. তাহের জানান, ৩১টি দলের মধ্যে ২৫টি পিআরের পক্ষে। জামায়াত উভয় কক্ষে পিআর চায়, তবে অন্য দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। সরকার সিদ্ধান্ত না নিলে ধীরে ধীরে আরও কর্মসূচি দেওয়া হবে। নির্বাচন বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “পাঁচ মাস সময় আছে। এর মধ্যে সনদকে আইনগত ভিত্তি দেওয়া এবং প্রয়োজনে গণভোট সম্ভব।”

চরমোনাই পীরের জোটের ইঙ্গিত

পুরানা পল্টনে ইসলামী আন্দোলনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, “ইসলামী দলগুলো জোটবদ্ধ হওয়ার কাছাকাছি। নির্বাচনে দেশ ও মানবতাপ্রেমীদের ভোট এক বাক্সে আনার পরিবেশ তৈরি হয়েছে।” তিনি দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কঠোর কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “একটি পক্ষের আচরণে মনে হয়, অভ্যুত্থান শুধু ক্ষমতার পালা বদলের জন্য ছিল। এটি মেনে নেওয়া যায় না।” তিনি জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির ওপর জোর দিয়ে বলেন, “নির্বাচনের আগেই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে।” জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “জাতীয় পার্টি ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির এজেন্ট। তারা ফ্যাসিবাদকে সহায়তা করেছে।”

রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, “জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ দলগুলো চাপ তৈরির কৌশল হিসেবে আন্দোলনে নেমেছে। এই চাপ শুধু সনদ বাস্তবায়নের জন্য, নাকি আসন ভাগাভাগির জন্য, তা বুঝতে সময় লাগবে।”

সংলাপের অগ্রগতি

আগামী বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) কমিশন আবার দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসবে। দুই দিনের বিরতিতে দলগুলোকে মতপার্থক্য দূর করার আহ্বান জানানো হয়েছিল। তবে, বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “এমন কোনো উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি না।”