Image description

সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। এতে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। এদিন রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে পাঁচ ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন আন্দোলনকারীরা। এতে গুরুত্বপূর্ণ এই মোড় দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হওয়ায় আশপাশের এলাকায় তীব্র যানজট তৈরি হয়। সন্ধ্যায় শাহবাগ মোড় ছেড়ে যাওয়ার সময় পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন আন্দোলনকারীরা।

দাবি আদায়ে আগামী রবিবার সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন তারা। আগের দুই দিনের ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) বেলা ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে বের হন বিক্ষোভকারীরা। ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে স্লোগান দেন শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে মিছিলটি শাহবাগে এসে থামে দুপুর ১২টা ১৮ মিনিটে।  এরপর থেকে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়ে দাবির পক্ষে স্লোগান ও বক্তব্য দিতে থাকেন তারা। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে সড়ক থেকে চলে যাওয়ার আগপর্যন্ত সেখানে বসে নানা স্লোগান দেন। দুপুরে বৃষ্টির মধ্যেও অবরোধ কর্মসূচি অব্যাহত ছিল। কর্মসূচিতে ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের মূলকথা সুযোগের সমতা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই/একাত্তরের বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে’, ‘দফা এক দাবি এক, কোটা নট কাম ব্যাক’ প্রভৃতি স্লোগান দেয়া হয়।

অবরোধ চলাকালে পাশেই বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য অবস্থান করছিলেন। তবে তারা শিক্ষার্থীদের বাধা দেননি। বিকাল পাঁচটার দিকে পুলিশ সদস্যরা হেলমেট পরে প্রস্তুত হলে তাদের মুখোমুখি হয়ে পড়েন আন্দোলনকারীরা। তবে মিনিট কয়েকের মধ্যেই পরিস্থিতি শান্ত হয়। অবরোধ প্রত্যাহারের আগে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাহিদ ইসলাম নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, দাবি আদায়ে শুক্রবার চার দফা দাবির ভিত্তিতে অনলাইন ও অফলাইনে জনসংযোগ ও সারাদেশে সমন্বয়, শনিবার বেলা তিনটায় সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হবে এবং রবিবার সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন ও ছাত্র ধর্মঘট পালিত হবে।

কর্মসূচি ঘোষণার আগে নাহিদ ইসলাম বলেন, আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে সরকারের নির্বাহী বিভাগ কোটা বাতিল করে যে পরিপত্র জারি করেছিল, আজকে বিচার বিভাগ দিয়ে সেই কোটাকে আবার পুনর্বহাল করা হলো। এটা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটা প্রহসন।

২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল। এরমধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১০ শতাংশ নারী কোটা, অনগ্রসর জেলার বাসিন্দাদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জন্য ৫ শতাংশ আর প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ আসন সংরক্ষিত ছিল। ওই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের দাবিতে বড় ছাত্র আন্দোলন হয়। সংস্কারের দাবি উঠলেও সে বছরের ৪ অক্টোবর কোটা বাতিলবিষয়ক পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ওই পরিপত্রের মাধ্যমে ৪৬ বছর ধরে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে যে কোটা ব্যবস্থা ছিল, তা বাতিল হয়ে যায়। পরে ২০২১ সালে সেই পরিপত্রের মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান উচ্চ আদালতে রিট করেন। সেই রিটের রায়ে গত ৫ জুন পরিপত্রের ওই অংশটি অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকেই চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীরা মাঠে নামেন।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহালের পাশাপাশি আরও কিছু দাবি জানাচ্ছেন। এগুলো হলো, পরবর্তী সময়ে সরকার কোটা ব্যবস্থা নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে চাইলে ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দেয়া, সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করা, চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করার সুযোগ বন্ধ করা ও কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দেয়া এবং দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মুখপাত্র নাহিদ ইসলাম বলেন, সরকারের নির্বাহী বিভাগের এখনও ক্ষমতা আছে পুনরায় কোটা বাতিলের পরিপত্র জারি করার। তিনি বলেন, ‘আদালতের কাছে আমাদের সুপারিশ থাকবে, মহামান্য আদালত যেন আমাদের কথাগুলো বিবেচনা করেন। নির্বাহী বিভাগকে আমরা প্রশ্ন করতে চাই, ২০১৮ সালে তারা কী এমন পরিপত্র জারি করল, যা পাঁচ বছরের মধ্যে বাতিল হয়ে যায়? তাহলে সেই পরিপত্রের মধ্যে ভুল রয়েছে। নির্বাহী বিভাগ যথাযথ বিধিবদ্ধভাবে সেই পরিপত্র জারি করতে পারেনি। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রহসন করা হয়েছে।’

ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ শিক্ষার্থীদের: এদিকে কোটা বাতিল ও ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপন পুনর্বহালের দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বের হয়। এরপর সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোটবাড়ি বিশ্বরোড এসে অবরোধ করেন তারা। এ সময় বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই’, ‘আমার সোনার বাংলায় বৈষ্যমের ঠাঁই নাই’, ‘লেগেছেরে লেগেছে রক্তে আগুন লেগেছে’- ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন। এ ঘটনায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উভয় লেনে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়।

এদিকে, বৃষ্টি উপেক্ষা করে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে শিক্ষার্থীদের ব্যানারে আন্দোলন শুরু হয়। পরে তারা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখেন শিক্ষার্থীরা। এতে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনকারীরা তাদের ৪ দফা দাবি জানান। দাবিগুলো হলোÑ ২০১৮ সালের পরিপত্র অনুযায়ী কমিশন গঠন করে কোটা পদ্ধতির সংস্কার করতে হবে, একজন ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় সরকারি চাকরিতে একবার কোটা সুবিধা ভোগ করতে পারবে, অর্থনৈতিক সমীক্ষার মাধ্যমে কোটা পদ্ধতি পুনঃমূল্যায়ন করতে হবে এবং দুর্নীতিমুক্ত মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করতে হবে।

মানবকণ্ঠ/এসআরএস