
ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ভারি বর্ষণের সঙ্গে দেশে টানা বৃষ্টি হওয়ায় নদ-নদীতে পানি বাড়ছে। এতে দ্বিতীয়বার বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে উত্তরাঞ্চলে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের সুরমা, যাদুকাটা ও পুরাতন সুরমার পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
টানা বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। নিম্নাঞ্চলের পাশাপাশি নগরীতেও পানি প্রবেশ করেছে। এছাড়া নেত্রকোনার সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও এর পাশে উজানে আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে।
পূর্বাভাস কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান জানিয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদের কিছু পয়েন্টে পানির সমতল স্বল্প মেয়াদের জন্য বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। এই সময় সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোণার নিম্নাঞ্চলের কিছু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে মৌলভীবাজারের বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মুহুরী, ফেনী, হালদা, সাঙ্গু ও মাতামুহরী নদীর পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হতে পারে। এছাড়া আগামীকাল বৃহস্পতিবার ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কয়েকটি পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করার আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে আবহাওয়ার যে পূর্বাভাস, তাতে আগস্টের দিকে বন্যার শঙ্কা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন থেকেই মন্ত্রী-সচিবদের প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুস সালাম। মঙ্গলবার (২ জুলাই) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা আসে। বৈঠকের পর পরিকল্পনামন্ত্রী সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। মন্ত্রী বলেন, “তিনি (প্রধানমন্ত্রী) ধারণা করছেন, আমাদের বন্যা হতে পারে। আমাদেরকে বলেছেন প্রস্তুত থাকতে, বন্যা যদি হয়েই যায়, তাহলে আমরা যেন দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারি।”
সারা দেশেই বন্যর শঙ্কা রয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন করা হলে পরিকল্পনা সচিব সত্যজিত কর্মকার পরে সাংবাদিকদের বলেন, “প্রধানমন্ত্রী সেভাবে বলেননি, তবে আমাদের প্রস্তুত থাকতে বলেছেন, যেহেতু বন্যার শঙ্কা রয়েছে।”
পূর্বাভাস অনুসারে, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর এবং বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা তৈরি হচ্ছে। সেই সঙ্গে রয়েছে বায়ুচাপের তারতম্য। এর প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যে কারণে গতকালও চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। মঙ্গলবার আবহাওয়াবিদ শাহনাজ সুলতানার সই করা সতর্কবার্তায় এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, উত্তর বঙ্গোপসাগর এবং তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবল অবস্থায় রয়েছে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা তৈরি অব্যাহত ও বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করছে।
পাশাপাশি উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারসমূহকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। দুর্ঘটনা এড়াতে উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত নৌকা ও ট্রলারগুলোকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। এদিকে উজান ভারী বর্ষণের ফলে পাহাড়ি ঢলে বাড়ছে বন্যার আশঙ্কা।
জুলাইয়ের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে কয়েকটি অঞ্চলে স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদী বন্যার আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। উজানের ঢল আর ভারি বৃষ্টিতে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোণা ইতোমধ্যে বন্যার কবলে পড়েছে। বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে ফেনীর নিচু এলাকা। বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সিরাজগঞ্জেও।
সুনামগঞ্জ: দ্বিতীয় দফায় ১২ দিন পর সুনামগঞ্জ বন্যার মুখে; পানি নেমে যাওয়া এলাকা আবারও প্লাবিত হয়েছে। পাহাড়ি ঢল ও জেলায় একদিনের রেকর্ড বৃষ্টিতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
মঙ্গলবার সুনামগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী-২ ইমদাদুল হক জানান, সুনামগঞ্জ পয়েন্টে সুরমার পানি দুপুরে বিপৎসীমার ২৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সকাল থেকে বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকায় নদীর পানি কিছুটা কমছে। তিনি বলেন, সোমবার সকাল ৯টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে; যা এ জেলায় বছরের রেকর্ড। মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ভারি বর্ষণ হচ্ছে। এ কারণে আবারও বন্যা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান পাউবোর এই নির্বাহী প্রকৌশলী।
তিনি আরো বলেন, এদিকে যাদুকাটায় ২১১, ছাতকে ২২৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। ছাতক পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি ও যাদুকাটা নদীর পানিও বিপৎসীমার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে।
সিলেট: টানা বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। নিম্নাঞ্চলের পাশাপাশি নগরীতেও পানি প্রবেশ করেছে। সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, গত তিনদিনে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ৬৪৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টির পরিমাণ কমেছে।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, “গত দুইদিন ধরে বৃষ্টিপাতের কারণে নদ-নদীর পানি বেড়েছে। তবে এখনও সার্বিক পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা কাজ করছেন; ত্রাণ বিতরণও অব্যাহত আছে। ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ, ওসমানীনগর ও বিশ্বনাথে পানি একটু বৃদ্ধি পেয়েছে। পানি বাড়ার কারণে আবার আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষজন আসতেছেন।”
খাগড়াছড়ি: টানা বৃষ্টিতে খাগড়াছড়ির কয়েকটি নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে বহু মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে উঠেছেন। এদিকে সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় খাগড়াছড়ির সঙ্গে দীঘিনালা উপজেলা এবং রাঙ্গামাটির লংগদু ও বাঘাইছড়ি উপজেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে পর্যটন উপত্যকা সাজেক। ফলে সেখানে বেড়াতে যাওয়া প্রায় ৬শ পর্যটক আটকা পড়েছেন।
খাগড়াছড়ি ফায়ার সার্ভিসের লিডার মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘জেলার বেশ কয়েকটি পাহাড় নাজুক অবস্থায় রয়েছে। টানা বৃষ্টি হলে ধসের আশংকা রয়েছে। তবে আমরা সার্বক্ষণিক প্রস্তুত আছি।’
খাগড়াছড়ির স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে সোমবারই (১ জুলাই) ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলা হয়। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক শহিদুজ্জামান বলেন, ‘জেলায় প্রায় ১০০ আশ্রয় কেন্দ্র খোলা রয়েছে। সেখানে আশ্রিতদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাহাড়ে ঝুঁকিতে বসবাস করা পরিবারগুলোকে সরে যেতে আমরা অনুরোধ করেছি।’
নেত্রকোনা: ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে। জেলার উব্দাখালী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ছাড়াও গণেশ্বরী, মহাদেব, বাখলা, মঙ্গেলশ্বরী, বৈঠাখালী, কংস, সোমেশ্বরী ও ধনু নদীর পানি বাড়ছে। এতে উপজেলার সাত ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে।
নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বিকাল ৩টার দিকে উব্দাখালী নদীর ডাকবাংলো পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৫৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ওই পয়েন্টে বিপৎসীমা ৬ দশমিক ৫৫ মিটার। ওই উপজেলার কৈলাটি, বড়খাপন, পোগলা, খারনৈ, রংছাতি, কলমাকান্দা সদরসহ সাতটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের বেশ কিছু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
পাউবো নেত্রকোনা কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সারওয়ার জাহান জানান, উব্দাখালী নদীর পানি বাড়ছে। নদীর কলমাকান্দা ডাকবাংলো পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে সোমেশ্বরী নদীর বিজয়পুর পয়েন্টে পানি এখনো বিপৎসীমার ৩ দশমিক ৯২ মিটার নিচে রয়েছে। ওই পয়েন্টে বিপৎসীমা ১৫ দশমিক ৮৯ মিটার। নদীর দুর্গাপুর পয়েন্টে বিপৎসীমা ১২ দশমিক ৫৫ মিটার, সেখানেও পানি বিপৎসীমার ১ দশমিক ২৩ মিটার নিচে আছে। কংস নদের পূর্বধলার জারিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬১ সেন্টিমিটার নিচে এবং ধুন নদের খালিয়াজুরি পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জারিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমা ৯ দশমিক ৭৫ মিটার এবং খালিয়াজুরি পয়েন্টে বিপৎসীমা ৬ দশমিক ৫৫ মিটার। তবে আশা করা যাচ্ছে, ভারী বৃষ্টি না হলে বন্যার পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাবে।
কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসাদুজ্জামান বলেন, বন্যার পানিতে উপজেলার কিছু নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। আমরা চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে প্রতিটি গ্রামে খোঁজখবর নিচ্ছি। এখনো কেউ পানিবন্দি হয়নি। জরুরি মুঠোফোন নম্বর খোলা হয়েছে। শুকনা খাবারসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
মানবকণ্ঠ/এফআই
Comments