
একুশ শতকের সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ আমাদের অভিভাবকদের মনোভাব বুঝা! সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের আশায়, যেকোনো উপায়েই সন্তানকে ডাক্তার হতেই হবে, ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে অথবা বিসিএস ক্যাডার কিংবা বড়ো কোনো পদের সরকারি চাকরিজীবী। আর তার জন্য, শিশুকাল থেকেই খুব যতন করেই স্বীয় সন্তানদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপ! এবং প্রতিটি মা-বাবাই এটাই আশা করে, তার সন্তান পরীক্ষায় প্রথম হোক! জিপিএ-৫ অর্জন করুক। অথচ, জীবনে জিপিএ-৫ না পেলে, সরকারি চাকরি না পেলে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা বড়ো কোনো পদের চাকরি না পেলেও যে সুখী হওয়া যায়, সুখে থাকা যায়, এটা কোনো অভিভাবকই বুঝতেই চাইছে না। কিন্তু কেন? কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণকারের কবিতায় পড়েছি, ঈশ্বরী পাঠনী দেবী অন্নপূর্ণার কাছে বর চেয়েছেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে!’ আমাদের আধুনিক মায়েরা কি এ ‘দুধে ভাতে’ থাকার অভিপ্রায় বুঝে? যদি বুঝত, তারা কখনোই সন্তানকে জিপিএ-৫ পাওয়ার পিছনে দৌড়াতে দিত না, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা জজ ব্যারিস্টার হওয়ার পিছনে দৌড়াতে দিত না। তারা এটাই চাইত, যেন; তাদের সন্তান একজন ভালো মানুষ হোক।
গত ১২ মে আমাদের দেশের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এতে সারা দেশে ১১টি বোর্ডের অধীনে ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন পরীক্ষার্থী এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে, পাস করেছে ১৬ লাখ ৭২ হাজার ১৫৩ জন। এরমধ্যে ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। এখন কথা হলো, এ যে প্রায় সাড়ে চার লাখ শিক্ষার্থী যে ফেল করেছে কিংবা প্রায় ১৯ লাখ শিক্ষার্থী, যারা জিপিএ-৫ পায়নি, তারা কি কেউ দুধে-ভাতে থাকবে না? তারা কি কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বড়ো সরকারি পদের চাকুরে কিংবা সুখী মানুষ হবে না? যদি কেউ একজনও যদি এদের মধ্যে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরিজীবী হয়, তাহলে কি সুখী হওয়ার জন্য, জিপিএ-৫ দরকার আছে? আরেকটু পরিষ্কার করে যদি বলি, এই যে প্রায় ২ লাখ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে, তারা সবাই কি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বড়ো বড়ো পদের কর্মকর্তা হবে? যদি তা নয়, আমি মনে করি, আমাদের অভিভাবকদের উচিত, সন্তানের জিপিএ-৫ এর পেছনে না ছুটে, ভালো মানুষ হওয়ার পিছনে দৌড়া উচিত। এতে, একদিন আমাদের সন্তানেরা দুধে-ভাতে থাকবে। আর, আমাদের সন্তানেরা দুধে-ভাতে থাকলে, আমরাও দুধে-ভাতে এবং সুখে শান্তিতে থাকব। অন্যথায়, মানুষ্যহীন যে জিপিএ-৫ প্রত্যাশী জাতি আমরা তৈরি করছি, তাতে, তারা দুধে-ভাতে থাকলেও সুখে-শান্তিতে কেউ থাকবে না।
এবার পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে সাম্প্রতিক কিছু বিষয়ের অবতারণা করবো। এবারে যারা ফেল করেছে, তারা কেন এবং কীভাবে ফেল করেছে? প্রকৃত অভিভাবক, শিক্ষকেরা অনেকেই জানে, যারা পাস করার যোগ্য না, তারা অনেকেই বর্তমান সময়ের সিস্টেমের কারণে পাস করে গেছে। একজন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী হিসেবে, আমাদের সন্তানদের যে মেধা ও মনন দরকার, যে পারিপার্শ্বিক ও মানবিক শিক্ষা দরকার, তা তাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে কি আমরা পেরেছি? যদি না পারি তাহলে শিক্ষা অর্থহীন হয়ে যাবে। শিক্ষা মানবিক মানুষ তৈরির জন্য। আপনার সন্তানের একাডেমিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দিয়ে টাকা-পয়সা অর্জন সম্ভব হলেও মানুষের ভালোবাসা অর্জনের জন্য মানবিক শিক্ষার বিকল্প নেই। যার মধ্যে মনুষ্যত্বের শিক্ষা নেই, তার একাডেমিক শিক্ষার কোনো মূল্য নেই। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর, আরেকটা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। পঞ্চাশ-ষাট বছরের জীবন তার অর্ধেক যদি এ পড়াশোনার পিছনে ব্যয় করি, জীবনকে উপভোগ করবো কখন? আমাকে দিয়ে এসব হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এরকম আরও হাজার হাজার ভিডিয়ো আছে, যেখানে আমাদের সন্তানদের অধঃপতনের ছবি স্পষ্ট হয়ে আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসছে। সত্যিই এদের স্পর্ধা আমাদের ভাবতে বাধ্য করে, জাতি হিসেবে আমরা কোনদিকে যাচ্ছি? আসুন, এখনই অভিভাবক হিসেবে, সন্তান ও নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য, জিপিএ-৫ এর পিছনে না ছুটে সুশিক্ষা এবং মানবিক শিক্ষার পিছনেও কিছুটা সময় ব্যয় করি।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক
মানবকণ্ঠ/এসআরএস
Comments