Image description

প্রায় মাসব্যাপী দেশজুড়ে চলমান অতিরিক্ত গরম বা দাবদাহের কারণে হিটস্ট্রোক করে প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে ব্রয়লার মুরগি। ফলে তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে মাশুল দিতে হচ্ছে দেশের পোল্ট্রি খাতকেও। একইসঙ্গে আবার অত্যধিক তাপমাত্রায় ডিমের উৎপাদনও কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ। ফলে বড় লোকসানের মুখে পড়েছে মুরগি খামারিরা। 

এ অবস্থায় সাম্প্রতিক সময়ে খুচরা বাজারে ডিম এবং আগামী আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তিন মাস ব্রয়লার মুরগির সংকটের আশঙ্কা করছেন তারা। অতিরিক্ত গরমরে কারণে দেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নরসিংদী, রাজশাহী, দিনাজপুর, নওগাঁ, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, মেহেরপুর, খুলনা, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, কক্সবাজার ও বরিশাল অঞ্চলের মুরগি ব্যবসায়ীরা। সংকটে সহায়তার জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে 'ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম' গঠন করা হয়েছে। 

বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) সূত্র  জানায়, রোজার ঈদের (ঈদুল ফিতর) পর থেকে অতিরিক্ত গরমের কারণে পোল্ট্রি খাতে সংকট দেখা দিয়েছে। যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে তাপপ্রবাহ শুরু হওয়ার পর। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্রয়লার মুরগি লালনপালন করা খামারিরা। কারণ ব্রয়লার মুরগি গরম সহ্য করতে পারে না। ফলে তাপপ্রবাহের শুরু থেকে হিটস্ট্রোকে সারাদেশে প্রতিদিন গড়ে এক লাখের মতো মুরগি মারা গেছে। যার আনুমানিক বাজার মূল্য ২০ কোটি টাকা। এর প্রভাব পড়েছে ডিম উৎপাদনেও। 

সাম্প্রতিক সময়ে মুরগির উৎপাদন ৪-৮ শতাংশ এবং ডিমের উৎপাদন প্রায় ১০ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। ফলে অতিরিক্ত গরমের কারণে খামারে মুরগি মারা যাওয়ার কারণে যার প্রভাব পড়েছে বাজারে। ফলে গত সপ্তাহ ব্রয়লার মুরগির বিক্রি হয়েছে ২০০-২০৫ টাকা। আর একই ব্রয়লার মুরগি বর্তমান বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকা থেকে ২৪৫ টাকা। একইভাবে গত সপ্তাহ সোনালি মুরগি বিক্রি হয়েছে ৩২০ থেকে ৩৩০টাকা। চলতি সপ্তাহ বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকা থেকে ৩৯০ টাকা। লেয়ার মুরগি গত সপ্তাহ বিক্রি হয়েছে ৩১০ টাকা থেকে ৩৩৫ টাকা। চলতি সপ্তাহে লেয়ার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩৩০ টাকা থেকে ৩৬০ টাকা। 

এদিকে গরমে হিটস্ট্রোকে কত মুরগি মারা গেছে, সেই সংখ্যা নির্ণয় করতে সারাদেশের তথ্য সংগ্রহ করছে পোল্ট্রি খামারিদের সংগঠন বিপিএ। তাদের তথ্য বলছে, চলমান তাপপ্রবাহে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নরসিংদী এলাকার খামারিরা। এ অঞ্চলে গত ১৫ এপ্রিল থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ১০ দিনে তিন লাখ মুরগির মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া গাজীপুর অঞ্চলে দুই লাখ, চট্টগ্রাম অঞ্চলে এক লাখ ৭৫ হাজার, সিলেট অঞ্চলে ৫০ হাজার, যশোর অঞ্চলে এক লাখ ৫০ হাজার, পাবনা অঞ্চলে ৫০ হাজার এবং চুয়াডাঙ্গায় এক লাখ মুরগি মারা গেছে। ২৬ এপ্রিলের পর থেকে ১ মে পর্যন্ত ছয় দিনে এসব এলাকায় আট লাখ ব্রয়লার মুরগি এবং দুই লাখ সোনালি মুরগির মৃত্যু হয়েছে। এতে ডিমের উৎপাদন কমেছে ১০ শতাংশ। অন্যদিকে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ১০ শতাংশ। বিপিএ বলছে, তাপপ্রবাহের কারণে যত মুরগি মারা গেছে তার মধ্যে ব্রয়লার মুরগির সংখ্যাই বেশি।

অপরদিকে তীব্র গরমে খামারিরা বিপাকে পড়লেও সরকারের প্রাণিসম্পদ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাদের পাশে নেই বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার। 

তিনি বলেন, করপোরেট কোম্পানিগুলোর সিন্ডিকেটের কাছে সাধারণ খামারিরা এমনিতেই অসহায়। আবার বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে দায়সারা বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। যেখানে প্রান্তিক খামারিদের লাখ লাখ মুরগি মারা যাচ্ছে সেখানে তারা বলছেন, মাত্র চার হাজার মুরগির মৃত্যুর খবর পেয়েছেন। বিষয়টি স্পষ্ট যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সঙ্গে প্রান্তিক খামারিদের কোনো সংযোগ নেই। ফলে সরকারের এই দপ্তরের কাছে মুরগির মৃত্যুর কোনো তথ্য নেই। 'প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর করপোরেটদের সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। যার কারণে খামারির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ২০০৯ সালে দেশে এক লাখ ৬০ হাজার খামারি ছিল। এখন সেই খামারির সংখ্যা মাত্র ৬০ হাজার। সরকারের পক্ষ থেকে প্রান্তিক খামারিদের বিজ্ঞানভিত্তিক খামার গড়ে তোলার জন্য উন্নত প্রশিক্ষণ ও ঋণের ব্যবস্থা করা দরকার। তা না হলে আগামীতে ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি হতে হবে।

বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের মতে, দেশের বাজারে প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির চাহিদা তিন হাজার ৫০০ টন, সোনালি ও লেয়ার মুরগির চাহিদা এক হাজার ২০০ টন। এর বিপরীতে স্বাভাবিক সময়ে ব্রয়লার, সোনালি, লেয়ার মুরগি মিলে মাংস উৎপাদন হয়েছে পাঁচ হাজার ২০০ টনের বেশি। সংগঠনটির শঙ্কা, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে অনেক খামার বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে মুরগির উৎপাদন নেমে আসতে পারে চার হাজার টনে। আবার যেসব খামারে মুরগি মারা গেছে, সেখানে লোকসানের শঙ্কায় নতুন করে মুরগির বাচ্চা আনা হয়নি। কেউ কেউ লোকসান এড়াতে এই মৌসুমে কম পরিমাণে বাচ্চা পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনেকে খামার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তও নিয়েছেন। ফলে মাংসের বাজারে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। 

তাদের তথ্য মতে, খুচরা বাজারে প্রতিদিন ডিমের চাহিদা রয়েছে চার কোটি পিস। এর বিপরীতে খামারে স্বাভাবিক সময়ে সাড়ে চার কোটি পিস ডিম উৎপাদিত হয়। যা চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু তাপপ্রবাহের প্রভাবে এখানেও সংকট দেখা দিয়েছে। বর্তমানে প্রতিদিন তিন কোটি ৮০ লাখ থেকে ৯০ লাখ পিস ডিম উৎপাদন হচ্ছে। ফলে প্রতিদিন প্রায় ২০ লাখ ডিমের ঘাটতি থাকছে।

চলমান পরিস্থিতিতে খামারিদের সার্বিক বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে 'ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম' গঠন করা হয়েছে। তারা খামারিদের করণীয় সম্পর্কে উঠান বৈঠক, আলোচনা সভার মাধ্যমে সচেতন করছেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা জেলার বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দপ্তরের উপ-পরিচালক (ভেটেরিনারি পাবলিক হেলথ) ডা. মো. মোস্তফা আশরাফ। 

তিনি বলেন, মুরগির শরীরের তাপমাত্রা মানুষের তুলনায় বেশি। স্বাভাবিকভাবে মুরগির তাপমাত্রা ১০৩-১০৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট পাওয়া যায়। মুরগির জন্য ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাই বেশি। অথচ বর্তমানে তাপমাত্রা প্রায় ৩৭-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের কোনো কোনো এলাকায় তাপমাত্রা এর চেয়েও বেশি। সেজন্য মুরগির মৃত্যু হচ্ছে। ডিম উৎপাদনের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ছে।

চট্টগ্রামের পটিয়ার খামারি মো. শহিদুল আলম বলেন, আমার খামারে দুই হাজার ব্রয়লার মুরগি ছিল। অনেক সাবধানতা অবলম্বন করার পরও অতিরিক্ত গরমের কারণে হিটস্ট্রোকে ৬০০ ব্রয়লার মুরগি মারা গেছে। প্রতিটি মুরগির ওজন ছিল এক কেজি ২০০ গ্রাম থেকে দেড় কেজি। বাজারমূল্য হিসাব করলে ক্ষতি হয়েছে প্রায় এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। এখন আল্লাহর কাছে হাত তুলে দোয়া করা ছাড়া কিছুই করার নেই। 

চার-পাঁচ বছর ধরে পোল্ট্রি ব্যবসা করলেও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনও হতে হয়নি বলে জানান দিনাজপুরের খামারি শাহ আলম। তিনি বলেন, আমার প্রায় দুই হাজার ব্রয়লার মুরগি গরমে মারা গেছে। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। অনেকদিন ধরে খামার পরিচালনা করলেও আমি শুরুর দিকে বিষয়টি বুঝতে পারিনি। চোখের পলকে এমন সর্বনাশ হয়েছে।

আরিয়ান হোসেন নামের আরেক খামারি বলেন, গরমের কারণে আমাদের বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। প্রতিদিন ২০-৫০টির মতো মুরগি মারা যাচ্ছে। আবার গরমের কারণে অতিরিক্ত যত্ন নিতে গিয়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু মুরগি বিক্রির সময় ন্যায্য দাম পাচ্ছি না।

মানবকণ্ঠ/আরএইচটি