সময়ের আলোচিত-সমালোচিত নাম মিল্টন সমাদ্দার। অনেকের কাছে তার পরিচয় সমাজসেবক হিসাবে। মাঝে মাঝেই তিনি মানুষের সেবার জন্য অন্যদের কাছে অর্থ সাহায্য চাইতেন। সাড়াও পেতেন তাতে। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই মিল্টনের নাম ও কাজ নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা। চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে সমাজ সেবা ও মানবতার আড়ালে নানান অপকর্মের খবর উঠে এসেছে। যার ফলে এখন তার অবস্থান পুলিশ রিমান্ডে।

বুধবার (১ মে) সন্ধ্যার পর রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। মৃত ব্যক্তিদের জাল মৃত্যুসনদ দেয়ার অভিযোগে করা মামলায় ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ আশ্রমের চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দারের তিনদিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত।

বৃহস্পতিবার (২ মে) ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের আদালত এ আদেশ দেন। এদিন মিল্টনকে আদালতে হাজির করে তাকে সাতদিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক কামাল হোসেন।

বর্তমানে ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমেছে। মানবপাচার, বাচ্চা শিশুর ওপর হামলা, দুটি টর্চার সেল গঠন, অসহায় মানুষের নামে সংগ্রহ করা অর্থ আত্মসাৎ, তাদের কিডনিসহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চুরি করে বিক্রি, জাল মৃত্যুসনদ তৈরি এবং জমি দখলের মতো গুরুতর সব অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গ্রেপ্তারের পর মিল্টন সমাদ্দারের  বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে প্রতারণা, মানবপাচার, নির্যাতন কয়েকটি অভিযোগ এনে দু?টি মামলা করা হয়েছে মিরপুর ম?ডেল থানায়। এক? মামলার বাদী হয়েছে পু?লিশ।

কে এই মিল্টন সমাদ্দার: হঠাৎ করে আলোচনায় আসা এই মিল্টন সমাদ্দার কে? তাকে গ্রেপ্তারের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের জানান, বরিশালের উজিরপুরে বাড়ি মিল্টনের। সেখানে নিজের বাবাকে পিটিয়ে এলাকা ছাড়া হন এই ব্যক্তিা। এরপর ঢাকায় এসে শাহবাগে এসে একটি ফার্মেসিতে কাজ করেন। সেখানে ওষুধ চুরির কারণে তাকে বের করে দেয়া হয়। একপর্যায়ে কিছু লেখাপড়া করেন। পরে মিঠু হালদার নামের এক নার্সকে বিয়ে করেন। বিয়ে করার পর স্ত্রীকে নিয়ে মিরপুরে ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ নামে একটি আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করেন। সম্প্রতি মিল্টন সমাদ্দারের বিভিন্ন অপকর্ম বেরিয়ে আসে। এরপর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে নিয়ে শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। মুখ খুলতে থাকেন ভুক্তভোগীরা। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেন মিল্টন।

৯০০ মরদেহ দাফনের দাবি মিল্টনের, আসলে কত? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পেজে মিল্টন সমাদ্দার প্রায়ই দাবি করেন, তার আশ্রমে সবসময় ২৫০-৩০০ অসুস্থ রোগী থাকেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে রাস্তায় যারা মারা যান, তাদের দাফন করেন মিল্টন। আবার তার আশ্রমে অবস্থানকালেও অনেকে মারা যান। মিল্টনের দাবি, সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ৯০০ মরদেহ দাফন করেছেন তিনি। যাদের দাফন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ৬০০ জন তার আশ্রমে মারা গেছেন। আর বাকি ৩০০ মরদেহ রাস্তা থেকে এনে তিনি দাফন করেছেন। এসব মরদেহ রাজধানীর মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান, রায়ের বাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থান ও আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে বলে দাবি তার।

তবে গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে মিল্টনের মিথ্যা তথ্য দেয়ার বিষয়টি বেরিয়ে আসে। জানা যায়, মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে মিল্টন সমাদ্দারের প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে সব মিলিয়ে ৫০টি মরদেহ দাফন করা হয়েছে। এছাড়া রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে ১৫টির মতো মরদেহ দাফনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে আজিমপুর কবরস্থানে ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত কোনো মরদেহের দাফন হয়নি বলে গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন সেখানকার দায়িত্বরতরা। প্রশ্ন ওঠেছে, ৯০০ মরদেহ দাফন করা হলে বাকি ৮৩৫টি মরদেহ কোথায় গেলো?

মরদেহে কাটাছেঁড়া, মৃতদের সনদ দেন নিজেই: জানা গেছে, মিল্টন সমাদ্দারের দক্ষিণ পাইকপাড়া আশ্রমের কাছেই বায়তুর সালাম জামে মসজিদে একসময় তার প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসা মরদেহ বিনামূল্যে গোসল করানো হতো। তার মানবিক কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে মসজিদ কর্তৃপক্ষ তাকে এই সুবিধা দিয়েছিল। তবে গোসল করানোর সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা প্রায় প্রতিটি মরদেহের বিভিন্ন স্থানে কাটাছেঁড়ার দাগ শনাক্ত করেন। করোনার সময় এ বিষয়ে মিল্টনকে প্রশ্ন করে মসজিদ কর্তৃপক্ষ। এরপর তিনি ওই মসজিদে মরদেহ পাঠানো বন্ধ করে দেন।

স্থানীয় মাদ্রাসার পরিচালক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, মিল্টন একসময় বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে পারতেন না। এখন তিনি এগুলো করে কোটি কোটি টাকার মালিক। দামি গাড়িতে চড়েন। আমরা শুনেছি আড়ালে তিনি মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চুরি করেন। তিনি আরও বলেন, রাস্তা থেকে মানুষ তুলে আনার পর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। যাদের কিডনিসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ভালো থাকে, তাদের যথাযথ চিকিৎসা করানো হয়। তাদের জন্য ভালো খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এরপর সুস্থ হলে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেয়া হয়। সুস্থ মানুষ কিন্তু কিছুদিন পরে দেখি মারা যান। ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ এ কাজ করেছেনÑ এমন একজনের অভিযোগ, ‘কোনো রোগী অসুস্থ হলে সরকারি হাসপাতালে নেয়া হয় না। এখানে রেখেই চিকিৎসা করা হয়। কারণ, তিনি চান না কেউ পুরোপুরি সুস্থ হোক। এটা তার ব্যবসা।’

জানা গেছে, ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ আশ্রমে অবস্থানকালে কারও মৃত্যু হলে তার সার্টিফিকেট দেন মাহিদ খান নামের একজন চিকিৎসক। তবে তার স্বাক্ষর এবং সিলের সঙ্গে বিএমডিসির নিবন্ধন নম্বর উল্লেখ নেই। বিএমডিসির বিধি অনুযায়ী চিকিৎসকের স্বাক্ষর এবং সিলে নিবন্ধন নম্বর উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক। মিল্টনের আশ্রমে কাজ করা এক ব্যক্তির বক্তব্যের মিল পাওয়া যায় মৃতদের মৃত্যু সনদেও। যতজনকে দাফন করা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের ডেথ সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারের প্যাডে।

জমি দখলের অভিযোগ: মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে একাধিক ব্যক্তিকে মারধরের অভিযোগ রয়েছে। তার আশ্রমের ভেতরে রয়েছে নিজস্ব বন্দিশালা। সেখানে আছে লাঠিসোটা, পাইপসহ মারধরের নানা উপকরণ। চুন থেকে পান খসলেই তার লাঠিয়াল বাহিনী হামলে পড়ে। গত ঈদুল ফিতরের আগের দিন ১০ এপ্রিল সাভারের কমলাপুর এলাকার বাহেরটেকে নিজের কেনা জমি দেখতে গিয়ে বেধড়ক মারধরের স্বীকার হন মো. সামসুদ্দিন চৌধুরী নামে ৬৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি। এ ঘটনায় মিল্টন সমাদ্দারকে প্রধান আসামি করে সাভার মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে ভুক্তভোগী পরিবার।

আর্থিক হিসাবে অস্বচ্ছতা: সাধারণ মানুষের দানের টাকায় পরিচালিত অলাভজনক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেয় সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরে আওতাধীন জেলা সমাজসেবা কার্যালয়। মিল্টন সমাদ্দারও তার চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের অনুমোদন একই প্রক্রিয়য় নেন। তবে নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবছর নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান দিয়ে অডিট এবং দুই বছর পরপর নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি নবায়নের কথা থাকলেও তিনি সেটি করেননি। মিল্টন সমাদ্দারের পাঁচটি ফেসবুক পেজে বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের ১৬টি নম্বর দেয়া রয়েছে। এছাড়া তিনটি বেসরকারি ব্যাংকে খোলা হিসাবের মাধ্যমে চলে আর্থিক লেনদেন। এসব মোবাইল ব্যাংকিং এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বরে লেনদেনের তথ্য সংগ্রহ করে একটি দৈনিক পত্রিকা। তাতে দেখা যায়, প্রতি মাসে কোটি টাকার মতো জমা হয়। তবে মিল্টনের আশ্রমে থাকা সর্বসাকল্যে ৫০ জন মানুষের দেখাশোনার জন্য এই বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় হয় কি না- সেই প্রশ্ন ওঠে।

বরিশালে চার্চ দখল: বরিশালে ‘চন্দ্রকোনা খ্রিষ্টান মিশনারি চার্চ’ দখল চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে। দখলের উদ্দেশ্যে তিনি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সিল-স্বাক্ষর জাল করে চার্চের নতুন কমিটি গঠন করে বরিশাল জেলা প্রশাসকে একটি চিঠি দেন। ওই কমিটিতে সভাপতি করা হয় মিল্টন সমাদ্দারকে। কমিটির বাকি সদস্যদের প্রায় সবাই মিল্টনের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজন। তবে এ বিষয়ে কিছুই জানতেন না চার্চের দায়িত্বরত যাজকরা।

মানবকণ্ঠ/এসআরএস