Image description

ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু-জাকসু) নির্বাচনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনের (বাগছাস) চরম ভরাডুবি সত্যিই অপ্রত্যাশিত। গত বছরের গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী এই সংগঠনের প্রার্থীরা কেন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো? এই প্রশ্ন এখন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। শুধু বাগছাস নয়, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়নসহ বাম সংগঠনগুলোও ভোটের ময়দানে হেরে গেছে।

বাগছাসের অপ্রত্যাশিত পরাজয়

গত বছর অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সবচেয়ে সক্রিয় ছিল বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা। অনেকের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, বাগছাস প্যানেল এই নির্বাচনে চমকপ্রদ ফলাফল ঘরে আনবে এবং এটি এনসিপির রাজনীতিতে ইতিবাচক সাড়া ফেলবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

ডাকসুতে বাগছাসের কোনো প্রার্থী কেন্দ্রীয় সংসদের কোনো পদেই জয়লাভ করতে পারেনি। প্যানেলগত অবস্থানেও তারা চতুর্থ-পঞ্চম স্থানে সীমাবদ্ধ। জাকসুতে শুধু দুটি ছোট পদে জয় পেয়েছে তারা। এই ফলাফল এনসিপিকে নতুন করে ভাবাতে বাধ্য করেছে।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাবেক সদস্য সচিব ও এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বিবিসি বাংলাকে বলেন, "যদি বাগছাস ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগরে ভালো ফল করতে পারতো, তাহলে এর ইতিবাচক প্রভাব এনসিপির রাজনীতিতে পড়তো। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর কিছু কর্মকাণ্ডের নেতিবাচক প্রভাব এই নির্বাচনে পড়েছে। আমাদের কেউ কেউ রাষ্ট্র পরিচালনার খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। তাদের অনভিজ্ঞতা, অক্ষমতা কিংবা মিডিয়া ট্রায়ালের কারণে বিতর্কিত ইমেজ তৈরি হয়েছে।"

এনসিপির যুগ্ম সদর সচিব আরিফুল ইসলাম আদীব যোগ করেন, "প্রস্তুতির ঘাটতি এবং সাংগঠনিক দুর্বলতা ছিল। দেশের বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি বা নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে কিছু নেতার জড়িত থাকাও প্রভাব ফেলেছে।"

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, "অনেকে এনসিপিকে 'কিংস পার্টি' মনে করে। শিক্ষার্থীরা সবসময় স্ট্যাবলিশমেন্টের বিপক্ষে, তাই এই প্রভাবও পড়েছে।"

ছাত্রদলের ভরাডুবি ও মূল্যায়ন

বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলও এই নির্বাচনে চরম পরাজয়ের মুখে পড়েছে। ডাকসু ও জাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদের কোনো পদেই জয় পায়নি তাদের প্রার্থীরা। নির্বাচনের দিন নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে জাকসুতে ভোট বর্জনের ঘোষণাও দিয়েছে তারা।

ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বিবিসি বাংলাকে বলেন, "এমন ফলাফল কেন হলো, সেটা আমরা মূল্যায়ন করছি। নেপথ্যে কী ছিল, তাও খুঁজছি। শিগগিরই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠবো।"

সাবেক জিএস মুশতাক হোসেন যোগ করেন, "শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ছাত্রদলের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে। অনেক ছাত্র মনে করেছে, ছাত্রদল জিতলে পুরনো কায়দার রাজনীতি ফিরে আসবে। সেই আশঙ্কা থেকে ভোট পাইনি।"

ছাত্রদল এখন রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন নিয়ে পরিকল্পনা করছে এবং ব্যর্থতার মূল্যায়ন করে সামনে এগোবে বলে জানিয়েছে রাকিব।

বাম সংগঠনগুলোর সন্দেহ

বাম সংগঠনগুলোও এই নির্বাচনে হতাশাজনক ফল পেয়েছে। ডাকসুতে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্টসহ বিভিন্ন প্যানেলে অংশ নিয়েও কোনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য আসেনি। জাকসুতে অনিয়মের অভিযোগ তুলে ভোট বর্জন করেছে তারা।

ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ বলেন, "আমরা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করিনি, কিন্তু সংশয় আছে। ডাকসুতে অনিয়ম না হলেও কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং হয়েছে। জাকসুতে বিশৃঙ্খলা স্পষ্ট। গণঅভ্যুত্থানের পর হলগুলোর শৃঙ্খলা কমিটিতে শিবির নেতাদের ভূমিকা এই ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে।"

সত্তর-আশির দশকে যেখানে বাম সংগঠনগুলো ক্যাম্পাসে প্রভাবশালী ছিল, সেখানে এবারের ফলাফল তাদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তারা এখন নির্বাচনী প্রক্রিয়া মূল্যায়ন করে এগোবে বলে জানিয়েছে।

নতুন রাজনীতির পরীক্ষা

এই নির্বাচনগুলো নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ছাত্র আন্দোলনের একটা পরীক্ষা ছিল। গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্র সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক দুর্বলতা, নেতিবাচক ইমেজ এবং অনিয়মের অভিযোগ এখন সামনে এসেছে। এনসিপি, বিএনপি বা বামপন্থীদের জন্য এটি একটা শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা। আসন্ন নির্বাচনগুলোতে কীভাবে তারা এগোবে, তা দেখার বিষয়।