
দেশের উন্নয়ন ও রাজনীতিতে বড় ভূমিকা পালনকারী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি গণতন্ত্রায়নে এক প্রোজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। আজ ১ সেপ্টেম্বর দলটির ৪৭তম প্রতিষ্টাবার্ষিকী। এই উপলক্ষে ৭ দিনের কর্মসূচি পালন করছে দলটি। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রমনা গ্রিনে এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন।
একটি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস কেবল ক্ষমতার পালাবদলের ইতিহাস নয়, এটি জাতির আকাক্সক্ষা, সংকট ও সম্ভাবনারও দলিল। সেই দলিলের একটি উজ্জ্বল অধ্যায় ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। যে দিনটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্বাসন ও একটি নতুন রাজনৈতিক ধারার সূচনার সাক্ষী হয়ে আছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির প্রতিষ্ঠা কেবল একটি দলের জন্ম নয়, এটি ছিল একটি বিশেষ রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তার ফসল। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দলটি এখন চলছে রকেট গতিতে।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া দলটির হাল ধরেন। তার নেতৃত্বেই বিএনপি দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ক্ষমতার পালাবদলের পর এখন দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বড় ছেলে লন্ডন প্রবাসী তারেক রহমান। আগামী ২০২৬ সালে অনুষ্ঠিতব্য ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে এমনটাই আশা করছে দেশের সাধারণ মানুষসহ দলের নেতাকর্মীরা।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হন। এরপর নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৮৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিএনপির হাল ধরেন তারই সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া। বর্তমানে তিনি দলের চেয়ারপারসন। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় কারাদণ্ড দেয়া হয়। তিনি দুই বছরের বেশি সময় জেল খাটেন। ৮০ বছর বয়সী খালেদা জিয়া মামলা, কারাভোগ ও পরে অসুস্থতার কারণে রাজনীতিতে সক্রিয় নেই।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন তারেক রহমান। তিনি ২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। সেখান থেকেই দল পরিচালনা করছেন তিনি। ১৮ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে রয়েছে বিএনপি। বিএনপির যাত্রা কখনোই মসৃণ ছিল না। ২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে দলটি বড় আঘাত সহ্য করে।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জটিলতা, নেতৃত্বের ওপর দমননীতি, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাবাস, সবকিছু মিলিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। তারপরও ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ধারাবাহিক আন্দোলন প্রমাণ করে, বিকল্প শক্তি হিসেবে বিএনপি এখনো জনগণের প্রত্যাশার জায়গায় রয়েছে। বিশেষত নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে তারা গণতন্ত্রের প্রশ্নে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরতে পেরেছে।
ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে বিএনপির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ সংগঠনকে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে সংযুক্ত করা, গণআন্দোলনকে ভোটে রূপান্তর এবং রাজনৈতিক কর্মসূচিকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখা। বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই লক্ষ্যগুলোতে সফল হয়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রেখে যাওয়া ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বিএনপি আবারও জাতীয় রাজনীতির প্রধান স্হায়ী শক্তি হয়ে উঠতে পারবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিএনপি শুধু একটি দলের নাম নয়, বরং রাষ্ট্রের বিকল্প দর্শন ও গণতন্ত্রের প্রতীক। স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে শুরু করে ৯০-এর গণআন্দোলন, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি কিংবা সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান সবক্ষেত্রেই বিএনপি নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বিএনপির অবদান: মহান স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) জন্ম হলেও তারা একাধিকবার সরকার গঠন করেছে এবং প্রধান বিরোধীদলের ভূমিকাও পালন করেছে। এই সময়ে বাংলাদেশের যে অর্জন তাতে বিএনপির ভূমিকা কতটুকু- এমন প্রশ্নে দলটির নির্বাহী কমিটির সদস্য বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ বলেন, বিএনপি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার দল, গণতন্ত্রায়নের দল। বাংলাদেশের একদলীয় ব্যবস্থা থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্রে উত্তরণে বিএনপি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছে। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে দেশের শক্তিশালী অর্থনীতির যে ভিত্তি তা বিএনপিরই অর্জন।
দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিএনপির অর্জন অনেক। একদলীয় শাসন থেকে জাতিকে মুক্ত করে বিএনপি বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিএনপি ফিরিয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর দেশে আওয়ামী লীগসহ সবাইকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছে বিএনপি। বটমলেস বাস্কেট থেকে একটা আধুনিক বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল বাংলাদেশ বিশেষ করে আজকের গার্মেন্টস, রেমিট্যান্স এগুলো বিএনপির হাতে গড়া। এগুলো জিয়াউর রহমান করেছেন।
পরবর্তীতে আবার যখন স্বৈরাচার এরশাদ গণতন্ত্র হরণ করেছে আবার বেগম খালেদা জিয়া সংগ্রাম করে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এরশাদবিরোধী আন্দোলন করেছেন। এরশাদের পতন ঘটিয়েছেন। এর প্রতিদান হিসেবে জনগণ তাকে বিজয়ী করেছে। এখন আমরা আবার শেখ হাসিনার সেই স্বৈরাচারের হাত থেকে দেশ মুক্ত করলাম।
অপরদিকে স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর একদলীয় শাসনামল শেষে দেশ যখন একটি রাজনৈতিক ভ্যাকুয়ামে নিপতিত, তখন গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং একটি বিকল্প রাজনৈতিক ধারা গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছিল। স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের পাশাপাশি একটি শক্তিশালী ও সংগঠিত বিকল্পের অনুপস্থিতি তখন স্পষ্ট।
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীসহ অনেক প্রবীণ নেতা তখনো সক্রিয় থাকলেও, সেই শূন্যতা পূরণের জন্য প্রয়োজন ছিল একটি সুসংগঠিত, সুস্পষ্ট আদর্শভিত্তিক এবং সার্বজনীন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের। এই শূন্যতা পূরণ করতেই আত্মপ্রকাশ করে বিএনপি। এর প্রতিষ্ঠাতা, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’-এর যে তত্ত্ব উপস্থাপন করেন, তা ছিল একটি জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের সন্ধানে একটি যুগোপযোগী দার্শনিক ভিত্তি। এটি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং সকল নাগরিকের সমান অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ধারণা।
প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শুধু একটি দলই গড়ে তোলেননি, বরং ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ ধারণার ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্রদর্শন দাঁড় করান। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি সংখ্যালঘু নাগরিকদের সমান অংশগ্রহণের রাজনৈতিক মঞ্চ হিসেবে বিএনপি জন্ম নেয়।
স্বাধীনতার ঘোষক থেকে রাষ্ট্রনায়ক: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাদের গণহত্যার শুরু হলে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা তাঁকে জনমানসে প্রথম পরিচিতি দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী অফিসার হিসেবে তাঁকে স্বীকৃতি এনে দেয়। নয় মাসের যুদ্ধে তিনি ছিলেন ‘জেড ফোর্স’-এর ব্রিগেড কমান্ডার। স্বাধীনতার পর তিনি দক্ষ সামরিক অফিসার হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে সিপাহি-জনতার বিপ্লব তাঁকে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সামনে নিয়ে আসে। ‘আমি মেজর জেনারেল জিয়া, আপনারা ধৈর্য ধরুন’-এই বার্তা তখনকার সংকটকালে জনমনে আস্থা ফিরিয়ে আনে।
রাষ্ট্র পুনর্গঠন ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলা: রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে জিয়াউর রহমান প্রথমেই সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক পুনর্গঠন ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। সামরিক বাজেট বৃদ্ধি, নতুন ডিভিশন গঠন, পুলিশ ও গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করার পদক্ষেপ ছিল তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশল। কিন্তু এর চেয়েও বড় পদক্ষেপ ছিল বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন। একদলীয় শাসনের সংকট থেকে বেরিয়ে তিনি রাজনৈতিক দল গঠনের বৈধতা দেন। ১৯৭৬ সালে রাজনৈতিক দল বিধি জারি হলে আওয়ামী লীগ, বাম ও ডানপন্থি শক্তিগুলো পুনরায় সংগঠিত হওয়ার সুযোগ পায়।
বিএনপির জন্ম ও গণতান্ত্রিক ভিত্তি: বহুদলীয় রাজনীতির একটি প্রধান শক্তি হয়ে উঠতে জিয়া ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। দেশজুড়ে গণসংযোগে বের হয়ে ৭০টিরও বেশি জনসভায় ভাষণ দেন। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করেন। ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার নির্বাচন জনগণের ভোটাধিকারের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন অনুষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এই নির্বাচনকে বাংলাদেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপনের অন্যতম মাইলফলক ধরা হয়।
ক্ষণজন্মা রাষ্ট্রনায়ক: ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিহত হন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। মাত্র সাড়ে ৪ বছরে তিনি যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ভিত্তি তৈরি করেছিলেন, তা এখনো প্রাসঙ্গিক। তাঁর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার বেগম খালেদা জিয়া একাধিকবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেন।
বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ‘৩১ দফা কর্মসূচি’র ভিত্তিতে বাংলাদেশকে মানবিক কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য ঘোষণা করেছেন। বিএনপির অর্জন কতটুকু- এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপির ভূমিকা অপরিসীম। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক ছিলেন। তিনি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা থেকে বহুদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তিনি গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিয়েছন।
বিএনপির আমলে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিএনপির আমলে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছিল। বিএনপির আমলে মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু হয়। দেশের উন্নয়নের ভিত্তি শহীদ জিয়াউর রহমানের আমলে তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, পরবর্তীকালে বাংলাদেশের যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সেটা প্রতিষ্ঠিত করেন বেগম খালেদা জিয়া। মুক্তিযুদ্ধের যে কথা বলা হয় সেই মন্ত্রণালয়ও খালেদা জিয়া প্রতিষ্ঠা করেন।
Comments