Image description

বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে ‘বেপরোয়া’ আচরণ এবং অভ্যন্তরীণ সংঘাত বেড়েছে, যার ফলে গত ছয় মাসে দলটির অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ৪২ জন নিহত হয়েছেন বলে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। এছাড়াও, এই সময়ে রাজনৈতিক সংঘাতে মোট ৬৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং ২ হাজার ৭৭০ জন আহত হয়েছেন।

আসকের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত, বিএনপি ও তার সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের মধ্যে সংঘাতের ফলে ৪৩ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে শুধু বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংঘাতে ২৬ জন নিহত হয়েছেন। বেশিরভাগ সংঘাত ও মৃত্যুর ঘটনাই বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনের মধ্যে সহিংসতায় ঘটছে।

বিএনপির দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, ৫ আগস্ট ২০২৪ এর পর থেকে সংঘাত ও সংঘর্ষের ঘটনায় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ৩ হাজার ২০০ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৮০০ বিএনপি নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার, পদ স্থগিত, কারণ দর্শানোর নোটিশ, সতর্কীকরণ ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ছাত্রদল ৪০০ জনকে বহিষ্কার ও ৬০০'র বেশি নেতা-কর্মীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক দল কমপক্ষে ১০০ জনকে বহিষ্কার ও ১৫০ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। যুবদলের শতাধিক নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের ক্ষমতায় আছে বলে মনে করছেন, এ কারণেই তাদের মধ্যে বেপরোয়া আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা মনে করেন, কেবল দল থেকে বহিষ্কার করেই দায় এড়ানো যায় না। যদি বহিষ্কারের পরও দলে ফেরার সুযোগ থাকে, তবে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। 

এ বিষয়ে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, "যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ নাই এবং তদন্তে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হয়নি তাদের আমরা আবার দলে ফিরিয়ে নিই। তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম। আমরা কাউকে ছাড় দেইনা। আমরা তো অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে বলেছি। পুলিশ কেন গ্রেপ্তার করে না। সরকারের কি দায় নেই? সরকার কেন মব সৃষ্টির সুযোগ দেয়?”

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মো. রেজাউল করিম বলেন, "শুধু দল থেকে বহিষ্কার করেই দায় এড়াতে পারে না কোনো রাজনৈতিক দল। তাদের এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে যাতে অপরাধে কেউ জড়াতে সাহস না পায়। যদি এমন হয় বহিষ্কার করার পরও আবার যদি দলে ফেরার সুযোগ থাকে তাহলে তো পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।"

মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, "বিএনপির মধ্যে এমন প্রবণতা তৈরি হয়েছে যে তাদের নেতা-কর্মীরা মনে করছেন গত ১৫-১৬ বছরের না পাওয়া তারা একসঙ্গে তুলে নেবেন। তাদের কেউ কেউ মনে করছেন তারাই ক্ষমতায়। ফলে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষে তারাই যুক্ত। বিএনপি এখন আর তাদের নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।"

তিনি আরও বলেন, "বিএনপি কোনো ঘটনা ঘটলে বহিষ্কার করছে বা অন্য কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু বহিষ্কার করার পরও তাদের দলীয় কর্মসূচিতে সক্রিয় থাকার সুযোগ দিচ্ছে। আবার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করাও হচ্ছে। ফলে তারা যে ব্যবস্থা নিচ্ছে তা তেমন কাজে আসছে না।"

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌহিদুল হক বলেন, "বিএনপি তার ইতিহাসে এবার সবচেয়ে বেশি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু তারপরও দলকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। কোনো বড় দল যখন ক্ষমতায় যায় বা শক্তি অর্জন করে তখন তাদের মধ্যে একটি গ্রুপ আছে যারা আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এখানেও তাই ঘটছে। আর যেসব সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তার ভবিষ্যৎ কী তা ওই নেতা-কর্মীরা জানেন।"

এসব ঘটনায় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির দায় থাকলেও সরকারের কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা সে প্রশ্ন তোলেন সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাসুদ কামাল। তিনি বলেন, "বিএনপির এখানে দায় আছে। নেতৃত্বের ব্যর্থতা আছে। যত রাজনৈতিক সংঘাত সংঘর্ষ হচ্ছে তাতে বিএনপি এগিয়ে। কিন্তু সরকার কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বিএনপি তো বলেনি যে, ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। সরকারের এমন উদ্দেশ্যও হয়তো থাকতে পারে যে প্রমাণ করা রাজনৈতিক সরকার আসলে পারবে না। অনির্বাচিত সরকারই থাকতে হবে।"

এদিকে, গত ৯ জুলাই পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় ব্যবসায়ী লাল চাঁদ সোহাগকে প্রকাশ্যে পাথর দিয়ে থেতলে হত্যা করা হয়েছে। নিহত সোহাগ যুবদলের সাবেক কর্মী বলে স্থানীয়রা জানালেও, পুলিশ এটিকে পূর্ব শত্রুতা ও বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফল বলছে। এই ঘটনায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়াও, গত শুক্রবার খুলনায় যুবদল নেতা মোল্লা মাহবুবুর রহমানকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। একই দিনে রাজধানীর পল্লবীতে চাঁদা না পেয়ে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গুলি ও হামলার ঘটনা ঘটেছে।

পুলিশের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর জানিয়েছেন, অপরাধ প্রতিরোধে পুলিশ আন্তরিকভাবে কাজ করছে এবং অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তিনি বলেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সামাজিক ও পারিবারিক অস্থিরতা থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি এবং এক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজের সকল সচেতন নাগরিকের ভূমিকা রাখা উচিত।

সূত্র ডয়চে ভেলে