
বাংলাদেশে বর্তমানে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ তা হলো মব জাস্টিস। গত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে শুরু হয় এই মব জাস্টিস নামক কার্যক্রমটি। এই কার্যক্রমটি প্রকৃতার্থে কতটা বিচারব্যবস্থার সাথে সম্পূরক বা সামঞ্জস্যপূর্ণ বা সভ্য সমাজে প্রচলিত হয়ে থাকে। এটা জানা দরকার। মবের ঘটনায় বাংলাদেশে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। মব জাস্টিস শব্দটি পৃথিবীর কোনো দেশের সংবিধানেই নেই। কিন্তু তারপর বিশ্বের বহু দেশে এই কার্যক্রমটি চলে আসছে।
মব শব্দটি সাধারণত ভিড় বা জনতা অর্থে ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে যখন সেই ভিড় কোনো ধ্বংসাত্মক বা বিশৃঙ্খল কাজে লিপ্ত থাকে। এটি একটি অনিয়ন্ত্রিত জনতাকে বোঝা যায়, যারা সহিংস বা আক্রমণাত্মক আচরণ করতে পারে। উদাহরণ হলো, যদি কোনো জনতা উত্তেজিত হয়ে কোনো দোকানে ভাঙচুর চালায়, তবে সেই পরিস্থিতিকে ‘মব অ্যাটাক’ বা ‘মব অ্যাকশন’ বলা যেতে পারে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, ‘মব রুল’ বা ‘মব লিঞ্চিং’ বলতে ভিড়ের দ্বারা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার মতো ঘটনা বোঝায়। সংক্ষেপে, ‘মব’ শব্দটি এমন একটি ভিড়কে বোঝায় যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন এবং যাদের আচরণ ধ্বংসাত্মক বা বিশৃঙ্খল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার-সংক্রান্ত বৈশ্বিক ঘোষণা অনুযায়ী, মব জাস্টিসের কারণে মানবাধিকারের বড় লঙ্ঘন হয়। ঘোষণার ১০ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনালের অধীনে সবার সমতার ভিত্তিতে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আর ঘোষণার ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার হলো, তাকে যেন নিরপরাধ বলে বিবেচনা করা হয়। একই সঙ্গে বিচারের সময় অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) হিসাবে, গত ৮ আগস্ট অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সাত মাসে গণপিটুনিতে অন্তত ১১৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৭৪ জন। আর গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে মোট ৭৯২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ২০২৪ সালে।
গত বছর এ ধরনের ঘটনায় ১৭৯ জন নিহত হয়েছেন। বিবিসির এক তথ্য থেকে আরও জানা যায়, বাংলাদেশে একের পর এক ‘মব ভায়োলেন্স’ বা ‘দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টির ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক বা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বাংলদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাবে, গত ছয় মাসে অন্তত ১৪১টি মবের ঘটনায় ৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশের রাজনীতিতে মব ইস্যুতে ভিন্ন ভিন্ন ন্যারেটিভ বা ধারণাও দেয়া হচ্ছে।
কোনো কোনো রাজনৈতিক দল মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ঘটনাগুলোকে ‘জনরোষ’ হিসেবে বর্ণনা করছেন। এমনকি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মবকে ক্ষুব্ধ মানুষের ‘প্রেসার গ্রুপ’ বলে ন্যারেটিভ দেন যা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়। এর পেছনে তাদের যুক্তি হচ্ছে, পতিত আওয়ামী লীগের সাড়ে পনেরো বছরের শাসনে রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্যাতিতদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকে কিছু ঘটনা ঘটছে। ভিন্ন ন্যারেটিভও রয়েছে রাজনীতিতে।
কোনো কোনো রাজনীতিক মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের ১১ মাসের শাসনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে। সে কারণে মবের জবরদস্তি দেখা যাচ্ছে। তবে বর্তমানে প্রভাবশালী দলগুলোর মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির বিরুদ্ধেও মবের অনেক ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কিছু বক্তব্য মবকে সমর্থন করে বলে ধারণা করা হয়।
রাজনীতিতে মব নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা, বক্তব্য বা ন্যারেটিভ, যাই থাকুক না কেনÑ পরিস্থিতি যে উদ্বেগজনক, এ ব্যাপারে দলগুলোর মধ্যে দ্বিমত নেই। মব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে দেশে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হতে পারে, এমন আশঙ্কার কথাও বলছেন কোনো কোনো রাজনীতিক। এটা চলতে থাকলে পরিস্থিতি মারাত্মক হবার কারণ হলো, মব জাস্টিস হলো এক ধরনের বিচার ব্যবস্থা, যেখানে কোনো ব্যক্তি বা দলের বিচার করার জন্য আইনের আশ্রয় নেয় না।
দেখা যাচ্ছে যে, জনতা নিজেরাই মারধর বা শাস্তির ব্যবস্থা করে। আর এ অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার নেপথ্য বিষয়টি হলো, এই ধরনের ঘটনার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, যেমন- পুলিশের প্রতি অবিশ্বাস, দ্রুত বিচার না পাওয়া বা সামাজিক অস্থিরতা। বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলে বা শহরেও মব জাস্টিসের ঘটনা মাঝে মাঝে ঘটে থাকে, যেখানে উত্তেজিত জনতা চোর বা অন্য কোনো অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মারধর করে। তবে মব জাস্টিস আইন ও বিচার ব্যবস্থার পরিপন্থী এবং এটি একটি গুরুতর অপরাধ। কারণ এর ক্ষতিকর প্রভাব হলো, মব জাস্টিস সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং মানুষের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে। এছাড়াও, এতে নিরীহ মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মব জাস্টিস একটি অনাকাক্সিক্ষত এবং বেআইনি কাজ, যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
‘জাস্টিস’ শব্দটি ‘ন্যায় বিচার’ বা ‘বিচার’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি নৈতিক এবং আইনি ধারণা যা সমাজে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করে। সাধারণভাবে, জাস্টিস হলো ন্যায় বিচার। বিচার ব্যবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তির অধিকার রক্ষা করা হয় এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিকে শাস্তি ও নির্দোষ ব্যক্তিকে মুক্তি দেয়া হয়। বিচার ব্যবস্থায় সমাজের সকল স্তরের মানুষের প্রতি সমান আচরণ করা হয় এবং সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা হয়।
অপরদিকে, ‘মব জাস্টিস’ বা জনতার বিচার একটি ভিন্ন ধারণা যা সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। ‘মব জাস্টিস’ হলো, যখন কোনো ব্যক্তি বা দলের প্রতি সন্দেহবশত উত্তেজিত জনতা আইন নিজের হাতে তুলে নেয় এবং অভিযুক্তকে মারধর বা শাস্তি দেয়, যা আইনের শাসনের পরিপন্থী। তাই রাষ্ট্র-সমাজে জাস্টিস প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা সমাজের শান্তি, শৃঙ্খলা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবে। সুতরাং রাষ্ট্রের আইন দ্বারা মব বন্ধ করা দরকার। মব জাস্টিসের ইতিহাস সম্পর্কে যা জানা যায়, অতীতে এ ধরনের বহু ঘটনা ঘটেছে।
পৃথিবীতে যখন মানুষ সামাজিক ব্যবস্থায় বসবাসের শুরু করে, তখন থেকেই মব জাস্টিস ছিল। তখনকার সমাজে লিখিত কোনো আইন ছিল না। বিচারকাজ চলত সম্প্রদায় কেন্দ্রিক রীতি-নীতির ভিত্তিতে। অপরাধের জন্য কোনো ব্যক্তিকে কী সাজা দেয়া হবে, সে সিদ্ধান্ত নিতেন সম্প্রদায়ের সদস্যরা মিলে। এই সাজাগুলো ছিল নৃশংস। সাজা দেয়া হতো জনসমক্ষে। জনসমক্ষে সাজা দেয়ার উদ্দেশ্য ছিল, অপরাধগুলো যেন ভবিষ্যতে আর না ঘটে।
বিগত শতকগুলোর দিকে তাকালেও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এর মধ্যে বহুল আলোচিত ১৬৯২ ও ১৬৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসে ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ঘটনা। হিস্ট্রি চ্যানেলের তথ্য অনুযায়ী, কালো জাদুচর্চার অভিযোগ তুলে তাদের ‘ডাইনি’ আখ্যা দেয়া হয়েছিল। তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পেছনে কাজ করেছিল কুসংস্কার, জনরোষের ভয় ও ধর্মীয় উগ্রবাদ। ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের সময় ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল, তার একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল মব জাস্টিস।
সে সময় প্যারিসের বাস্তিল দুর্গে হামলা চালিয়েছিল উচ্ছৃঙ্খল জনতা। শিরñেদ করে হত্যা করা হয়েছিল বহু মানুষকে। এ ছাড়া বড় জাতিগত হত্যা, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, দুর্নীতি এসব ঘটনার পর উত্তেজিত মানুষের হাতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নিপীড়ন এমনকি হত্যার নজির বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে। এগুলোও উত্তেজিত জনতার নিজেদের হাতে আইন তুলে নেয়ার বা মব জাস্টিসের উদাহরণ।
যেমন রিলিফ ওয়েবের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডা গণহত্যার পর ওই গণহত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে অনেককে হত্যা করেছিল উত্তেজিত জনতা। একটি মব সৃষ্টি হওয়া মানে ভবিষ্যতের জন্য আরেকটি মব তৈরির বীজ বপন করা। বাংলাদেশে সাধারণত রাজনৈতিক পেক্ষাপটের উপর ভিত্তি করেই মব সৃষ্টি হয়। সুতরাং ক্ষমতার পালা বদলে এটা চলতেই থাকবে যদি আইনের শাসন যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করা না যায়। আরেকটি বিষয়ের দিকে লক্ষ রাখা দরকার, তা হলো মবকে জাস্টিস না বলা। কারণ মবকে যদি জাস্টিস বলা হয়, তাহলে জাস্টিস শব্দটা হয়ে যায় অবমাননাকর।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
Comments