
মানুষ সামাজিক জীব। নিজেদের অস্তিত্ব টেকানোর স্বার্থেই এক সময়ে মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করা শুরু করেছিল। পরবর্তীতে অঞ্চলভেদে বসবাসের প্রচলনও দেখা দিয়েছিল যাতে শত্রুদের আগ্রাসী মনোভাব থেকে নিজেরা বেঁচে থেকে শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারে। আর এভাবেই এক সময়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা কাঠামোও গড়ে উঠেছে। পরবর্তীতে এই ঐক্য ও একতা, ভাষা বা ধর্মীয় কিংবা আঞ্চলিক সংস্কৃতির ভিত্তিতে মজবুত অবস্থাও লাভ করেছে। ফলে কালক্রমে এভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টিও উদ্ভূত হয়েছে।
বর্তমানে এটার বাড়াবাড়ি অবশ্য সাধারণ মানুষের জন্য অনেকটা উদ্বেগেরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে বিশ্বে এগুলো নিয়ে অনেকে রাজনৈতিক সুবিধাও হাতাচ্ছে দেদারসে। পরিণতিতে দিনকে দিন পৃথিবী হয়ে পড়ছে বসবাসের অযোগ্য। আর এটা সকল মানুষের জন্যই একটা উদ্বেগের বিষয়ই বটে। এতো গেল জোট বাঁধতে বাঁধতে একটা সময়ে এসে জমাট বাঁধা সাম্প্রদায়িকতার কুফল ভোগের বিষয়ে। এবার আসা যাক, ঠিক তার বিপরীত দিকের ব্যাপারে।
বর্তমানে পৃথিবীতে কঠিন বাস্তবতার মুখাপেক্ষিতার ভিত্তিতে একে একে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে সেটাও আদৌতে ভালো কথা নয়। এই ধরুন, মানুষ বাস্তবতার সঙ্গে লড়তে লড়তে একটা সময়ে এসে হয়ে পড়ছে বড্ড বেশি আত্মকেন্দ্রিক। তাদের ধারণা, তারা যে সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে সফলতার মুখ চোখে দেখেছে তাতে অন্যরা তাকে কোনো সাহায্যই করেনি। ব্যস, সেজন্য আমারও উচিত নয়, অন্যকে সাহায্য করার বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখা। আমি আমার মত আছি সেই তো ভালো। বরং অন্যের জন্য কিছু করলেও কেউ তো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেই না, বরং সুযোগ পেলে আরও বদনামই করে। সুতরাং কি দরকার এতটা উদার হওয়ার?
বিষয়টি যদি এখানেই ক্ষ্যান্ত দিতো তাও তো একটা কথা ছিল, বরং তারা শুধুমাত্র নিজের সন্তান-সন্ততি আর স্ত্রী নিয়ে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যেতেই অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এমন কি তারা চায়, আপন নাড়ির বন্ধনকেও অস্বীকার করতে। সেজন্য কেউ বা কাজের ব্যস্ততার অজুহাতে বাবা-মায়ের খোঁজখবর নেয়ারও ফুরসত পায় না।
আবার কেউ কেউ নিজের আখের গোছানো বা ভবিষ্যতের পুঁজি সংগ্রহ নিয়েই ব্যস্ত। তাদের এই ব্যতিব্যস্ততার কারণে নিজের ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথেও এক সময়ে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলে। ব্যস, এভাবেই তারা একটা নির্ঝঞ্ঝাট চাপ মুক্ত জীবনযাপন অতিবাহিত করতে চায়। এটাতেই মূলত তারা সুখ-শান্তি ও আরাম খুঁজে পেতে চায়। কিন্তু বাস্তবে কি তা হয়? আত্মকেন্দ্রিকতায় বা স্বার্থপরতায় কি আসলেই কোনো সুখ-শান্তি মেলে? এটা অবশ্যই মনস্তাত্ত্বিকভাবে বিশ্লেষণ করে দেখার আবশ্যকতা রয়েছে।
আমরা আজকে যে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করছি সেটা এ পর্যায়ে সেটেল করতে গিয়ে অনেকেরই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতার প্রয়োজন পড়েছে নিশ্চয়। সেটা বাস্তবে ভুলার ভান করলেও আমরা কি আদৌতে তা ভুলতে পারি? প্রতিনিয়ত একে অপরের সহযোগিতা ছাড়া কি পৃথিবীতে কেউ টিকে থাকতে পারে? নিশ্চয়ই পারে না। আর সেটাই চূড়ান্ত বাস্তবতা। তাই দায়সারা ভাব নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে আমরা সেটাকে অস্বীকার করতে চাইলেও রাতের অন্ধকারে নিরিবিলিতে চোখের সামনে প্রকৃত সত্যটা জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠে। আর এটাই বিবেকের তাড়নার প্রতিফলন বৈ কিছু নয়।
বিশেষ করে আমরা যারা যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠেছি তারা তো নিজেদের পরিবারের কাছে এক প্রকার কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ থেকেই যায় যা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। সেজন্য তাদের প্রতি দায়বন্ধতাকে এড়িয়ে আমরা একক পরিবারে স্ত্রী-সন্তানের প্রতি যতই দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করি না কেনো তা অসম্পূর্ণই রয়ে যায় আজীবন। যারা আমাদের জন্য জীবনে নিজেরা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে খুঁটিনাটি অনেক বিষয়ে নিজেদেরকে বিলিয়ে দিয়েছেন তাদের প্রতি কি আমাদের কোনোই দায়বদ্ধতা নেই? স্ত্রী তো সেসময়ে আমাদের জীবনে এসেছে যে সময়ে আমরা স্বাবলম্বী হয়ে আত্মনির্ভশীল হয়ে পড়েছিলাম।
কিঞ্চিৎ তার ব্যতিক্রম থাকলেও থাকতে পারে। তবে বাস্তবে অধিকাংশের ক্ষেত্রে তেমনটিই হয়েছে। তাই বলে গড়সাফটা তো আর ভেড়া হয়ে যাওয়া চলে না। আর সেটা মানাইও না। তো এখন যদি সন্তান-সন্ততির বিষয়টাও ধরি তাহলে দেখতে পায়, তাদেরকে আমরা জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসছি। অথচ চিন্তা করা উচিত এমনটি তো আমার বাবা-মাও আমাকে বেসেছে। আর তারা বর্তমানে এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছে যাদেরকে চাইলেও আর খুব একটা বেশিদিন নিজেদের মধ্যে ধরে রাখতে পারবো না।
কারণ তারা বয়সের ভারে কখন যেনো ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। অথচ সন্তানরা তাদের ওফাতের পরেও থেকে যাবে আরও দীর্ঘ সময় ধরে। তাই তাদেরকে পরেও গুরুত্ব দেয়া যাবে। কিন্তু আফসোসের বিষয়, এখানে আমরা গাণিতিক যোগ-বিয়োগে ভুল করি। শুধু তাই নয়, কখনো বা তাদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোরও বন্দোবস্ত করি কিংবা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে তাদেরকে এড়িয়ে চলি। কিংবা সমাজে তাদেরকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দিই। কোনো খোঁজখবরই রাখার প্রয়োজনটুকু মনে করি না। এসব কেনো?
কারণ আমরা বাস্তববাদী হলেও প্রকৃত বাস্তববাদী নয়। আজকে তাদেরকে যে অবস্থায় আমরা অবহেলাকরতঃ ছেড়ে দিচ্ছি সে অবস্থায় তো আমাদেরকেও খুব শীঘ্রই ছেড়ে দেয়া হবে। তখন আমাদের কি অবস্থা হবে? এমন কি যখন বয়সের ভারে নুইয়ে যাবো, কথায় অসংলগ্নতা এসে যাবে, কে আমাদের সাথে দু’টো কথা বলবে? নাতিপুতিরাও তো আমাদেরকে বাড়তি উপদ্রব মনে করবে।
কেউ আর কাছে ভিড়তে চাইবে না। সাধারণ সুখ-দুঃখের আলাপ করার জন্যও কাউকে কিছুক্ষণের জন্য কাছে পাওয়া যাবে না। সেদিন আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা বা চাকরি-বাকরির পদ-পদবিও কেউ জানতে চাইবে না। অতীতে কতটা দাপড়ে জীবনযাপন করেছি, কর্মস্থলে কতটা সম্মানের সাথে হুমকি-ধমকি দিয়ে চলেছি সেটাও কেউ জিজ্ঞাসা করে শুনতে চাইবে না। শরীরের শক্তি গেছে, অসুস্থতা শরীরে দানা বেঁধেছে।
পর্যায়ক্রমে নিজেরা নীরবঘাতক ব্যাধিতে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি, সেটাই সেদিনের প্রকৃত বাস্তবতা। সেদিন একাকী জীবনযাপনের অনেক ফুরসত মিলবে। তাই একক পরিবার নিয়ে আগেই এতটা উৎফুল্ল হওয়ার কিছু নেই। যে স্ত্রী-সন্তানের জন্য বাবা-মা-ভাই-বোনকে দূরে ঠেলে দিচ্ছি তারাও সেদিন দূর ছাই, দূর ছাই করে দূরে ঠেলে দেবে। সুতরাং বাস্তবতার জ্ঞান যেনো আমরা পূর্বেই উপলব্ধি করতে পারি সেজন্য বাস্তবসম্মত চিন্তা করা শিখতে হবে।
পরিবারের সুখ-শান্তির জন্য জীবন-যৌবন সব বিলিয়ে দিয়েও কোনো লাভ হবে না। বরং শত কিছু করার পরও তারা নির্দ্বিধায় বিনাসংকোচে বলে ফেলবে, ‘আমাদের জন্য তো জীবনে কিছুই করোনি তুমি’। তাই আক্কেল দাঁত উঠার এখনই উপযুক্ত সময়। যা বুঝার তা এখনই বুঝতে হবে। যা করার তা এখনই করতে হবে। স্ত্রী-সন্তানের বেলায়ই শুধু বাড়তি পিরিতি কেনো? যতদিন বাবা-মা-মঈ-মুরুব্বিরা বেঁচে আছে তাদেরকেই সর্বাগ্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে, এতে পরিবারে যা কিছুই হয়ে যাক না কেন?
মনে রাখতে হবে, মানুষকে প্রথমে হতে হবে মানবিক। আর সেটা আসে কৃতজ্ঞতা থেকে। তাই তো কোরআনেও বর্ণিত হয়েছে, ‘অকৃতজ্ঞতায়ই কুফুরি’। সুতরাং হেলাফেলা করার কোনো সুযোগ নেই। দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে অবহেলা করান একদমই চলবে না। পরিবার-সমাজের প্রতি নিজের করণীয় সম্মন্ধে সচেতন হতে হবে। দেশের প্রতি যে দায়বদ্ধতা আছে তা মিটিয়ে দিতে হবে। তার আলো-বাতাস-মাটি-পানি দ্বারা তিলে তিলে গড়ে উঠা এই দেহকে তার মধ্যেই সঁপে দেয়ার আগে এদেশের কল্যাণে নিজের মেধা-মগজ-জীবন-যৌবন সবকিছু বিলিয়ে দিতে হবে। তাহলেই আমরা হতে পারবো প্রকৃত মানুষ।
লেখক: গবেষক ও দার্শনিক
Comments