Image description

প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে আরাম আয়েসে পূর্ণ করেছে। বিপরীতে কম ঝামেলায়ও ফেলেনি। এই যেমন আমরা বিয়ে, জন্মদিনসহ নানা অনুষ্ঠানে ডেকোরেশন থেকে প্লেট ও গ্লাস ভাড়া না এনে দিব্বি ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের প্লেট গ্লাস এনে কাজ সারছি। এতে সুবিধা হলো কোনো পরিষ্কার করার ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে না। আর কাজ শেষে পাশের কোনো জায়গায় বিশেষত নদীর তীরবর্তী উন্মুক্ত স্থানে ফেলে দিলেই হলো! পরিবেশ মরুক, আমি তো বাঁচি! 

এভাবে প্লাস্টিকের কাপে চা খাচ্ছি আবার রাস্তার পাশেই ফেলে দিচ্ছি। সেই কাপ গিয়ে ড্রেনেজ সিস্টেম নষ্ট করছে। পানি আটকে শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। একটু সুবিধা করতে গিয়ে কত অসুবিধার জন্ম দিচ্ছি আমরা। আমরা চাইলেই যে, সব একবারে বন্ধ করতে হবে তা নয়। তবে এই দুটো পণ্যের ব্যবহার তো আমরা বাদ দিতেই পারি। 

আমরা চাইলেই এর ব্যবহার পুরোপুরি হঠাৎ বন্ধ করতে পারব না কেন সেটা বোঝা দরকার। কোনো শিল্প যখন ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে তখন এর সাথে জড়িয়ে যায় অসংখ্য মানুষের জীবন ও জীবিকা। এটির ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। হুট করে একেবারে বন্ধ করলে রাতারাতি এসব মানুষ বেকার হয়ে পরবে। যার প্রভাব সমাজে পরতে বাধ্য। 

এক তথ্যে জানা যায়, একবার ব্যবহারযোগ্য (ওয়ান টাইম) প্লাস্টিক বন্ধ হলে প্লাস্টিক খাতের ছয় হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর ফলে চাকরি হারাবে কয়েক লক্ষাধিক শ্রমিক-কর্মচারী। পাশাপাশি একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের তালিকায় এমন কিছু পণ্য আছে, যার সঙ্গে জড়িত আরও লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান, রয়েছে ১৩ লাখ ক্ষুদ্র বিক্রেতার জীবিকা। একইসঙ্গে সরকার বছরে রাজস্ব হারাবে ৪০ হাজার কোটি টাকার। 

প্লাস্টিক বর্জ্য এবং পলিথিন নিয়ে পরিবেশের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরমধ্যে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে। কিছু দেশ ইতোমধ্যেই একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। যে হারে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে এর ব্যবহার বাড়ছে এবং যত্রতত্র ফেলে দিয়ে পরিবেশের বারোটা বাজাচ্ছি তাতে সামনে সমূহ বিপদ অপেক্ষা করছে। তাই এখনই ভাবতে হবে আমরা কি করব। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০৬০ সাল নাগাদ বিশ্বে প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়ে তিনগুণ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। একই বছর জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক প্লাস্টিকের বার্ষিক উৎপাদন ১০০ কোটি ২০ লাখ টন দাঁড়াতে পারে।

আজকাল এর ব্যবহার এত বেড়েছে যে বলা চলে প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। এরমধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক। যার বিরুদ্ধে এখন মূলত সারাবিশ্বেই আলোচনা। প্রথমে মানুষের জীবনযাত্রাকে একটু সহজই করেছিল! তারপর সেটিই মানুষের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে চাইলেই সব দ্রুত হয় না। এখন আমরা চাইলেও খুব দ্রুত এসবের ব্যবহার রোধ করতে পারছি না। যেমনটা পারিনি পলিথিনের ব্যবহার ঠেকাতে। আইন করেও এর ব্যবহার বন্ধ করতে পারিনি। 

একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের পণ্য মানুষের বেশ সুবিধা করেছিল। কিন্তু সেই সুবিধা যখন পরিবেশের ক্ষতি করতে লাগল তখনই সমস্যার উৎপত্তি। প্লাস্টিকের একটি স্ট্র ব্যবহার করে আমরা যে ডাব খাচ্ছি তাও প্রকৃতির জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে তরুণ এবং যুব জনগোষ্ঠী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্লাস্টিক দূষণের জন্য বেশি দায়ী। এরমধ্যে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক পণ্যই বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্টেশন এক গবেষণায় বলছে, মুদি দোকান থেকে কেনা পণ্য বহন করার জন্য যেসব ব্যাগ ব্যাবহার করা হয়, সেগুলো প্রকৃতিতে মিশে যেতে ২০ বছর সময় লাগে। 

চা, কফি, জুস কিংবা কোমল পানীয়ের জন্য যেসব প্লাস্টিকের কাপ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো ৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। আর ডায়াপার এবং প্লাস্টিক বোতল ৪৫০ বছর পর্যন্ত পচে না। এভাবে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ব্যবহার পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। সাগর, নদী, পুকুর কোথাও পলিথিন ও প্লাস্টিকের দূষণ থেকে বাদ যাচ্ছে না। সাগরের মৃত প্রাণীদের পেটে পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর প্লাস্টিক। যা আমরা বিভিন্ন সময় সাগরের বুকে নিক্ষেপ করছি। 

একবারও ভেবে দেখছি না আমার ফেলে দেয়া এই প্লাস্টিক পণ্য প্রাণিকুলের জন্য সংকট বয়ে আনবে। তথ্যে জানা যায়, প্রতিবছর বাংলাদেশে ১ লাখ ৯২ হাজার ১০৪ টন পরিমাণ প্লাস্টিকের স্যাশে বা মিনিপ্যাক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। দেশের মানুষ দিনে প্রায় ১২ কোটি ৯০ লাখ প্লাস্টিকের স্যাশে ব্যবহার করে। ২০২১ সালের ২১ জুন থেকে ২০২২ সালের ২২ মে দেশে প্রায় ১০ লাখ ৬ হাজার টন ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের বর্জ্য উৎপাদিত হয়েছে। 

একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের বর্জ্য সঠিক ব্যবস্থাপনায় আনতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যতে ভুগতে হবে। আমরা জেনেও ভুলে যাই যে প্লাস্টিক কোনো প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি হয় না বরং এর প্রভাব এতটা মারাত্মক যে যুগের পর যুগ তা মাটিতে দিব্যি ঠিক থাকে। প্লাস্টিক পচতে বহু বহু বছর সময় লেগে যায়। মানুষের কাছে জনপ্রিয় হওয়ায় এর ব্যবহার কমার কোনো লক্ষণ নেই। এর ব্যবহার যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলা যায়, যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়া হয় তাহলে আজ পলিথিন যে বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে তখন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকও বুমেরাং হবে আমাদের জন্য। কেবল ভারত বা কানাডা নয় একবারের বেশি ব্যবহারযোগ্য নয় এমন প্লাস্টিক ব্যাগ ও অন্যান্য পণ্যের ব্যবহার কমানোর বড় ধরনের পরিকল্পনা করেছিল চীন। আমাদের দেশেও এখন ওয়ান টাইম পণ্যের জয়জয়কার।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধ রয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে বালি, জাভা, কমোডো দ্বীপে প্লাস্টিক ব্যাগ, স্ট্র নিষিদ্ধ। স্থানীয় খাবারের দোকানগুলোতে বাঁশের স্ট্র, কলাপাতা ও বায়োডিগ্রেডেবল প্যাকেট ব্যবহার করা হয় এখন। হোটেলগুলোয় রয়েছে পানির রিফিল স্টেশন। প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারে সেদেশে ৩৫০ থেকে ১ হাজার ৭০০ আমেরিকান ডলার জরিমানার আইন আছে। থাইল্যান্ড পর্যটন গন্তব্যগুলোতে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বন্ধ করেছে। 

মেরিন পার্কসহ দেশটির ১৫৫টি জাতীয় উদ্যানে ফোমের পাত্র, প্লাস্টিকের খাবারের পাত্র, গ্লাস, স্ট্র, বাসনপত্র এবং প্যাকেজিংয়ে একবার ব্যবহার করা যায় তেমন জিনিসপত্র নিষিদ্ধ করেছে। ২০২২ সালে দেশটি সিঙ্গেল-ইউজ প্লাস্টিক পণ্য, যেমন বোতল, স্ট্র, কাপ ইত্যাদি নিষিদ্ধ করে। প্রতিবার এ আইন লঙ্ঘনের জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে জরিমানা করা হয় ৫০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ আমেরিকান ডলার। ২০২২ সালে তাইওয়ান সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন করে। ভিয়েতনামে ২০২২ সাল থেকে দেশটির হা লং বে ও ফুঁ কুয়ক আইল্যান্ডে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক নিষিদ্ধ। 

কলাপাতা ও কাগজে খাবার পরিবেশন করা হয় সেসব জায়গায়। হোটেলগুলোতে রয়েছে বাঁশের টুথব্রাশ ও পানির রিফিল ব্যবস্থা। নিয়ম ভাঙলে ৫ লাখ থেকে ৫ কোটি ভিয়েতনামি মুদ্রা বা ২০ থেকে ২ হাজার ১০০ আমেরিকান ডলার জরিমানা করা হয়। সারাবিশ্বেই একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার এবং এর পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। এসব প্লাস্টিকজাত পণ্যের একটি বড় অংশই সমুদ্রে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন প্রথম প্রথম এসব একবার ব্যবহাযোগ্য প্লাস্টিক আমাদের হাতে আসে তখন বেশ ভালো লেগেছিল। আজও ভালোলাগে। 

কারণ যখন কাচের কাপের বদলে হালকা প্লাস্টিকের কাপে চা দেয় বিশেষভাবে এটা প্রচুর ব্যবহার হয়েছে করোনাকালীন সময়ে। রাস্তায়, অলিতে গলিতে এসব কাপ পরে থাকতে দেখেছি। এখন সেসব কোথায় গেছে? নিশ্চয়ই ড্রেনের মাধ্যমে নদীতে পৌঁছে গেছে? আবার বিয়ে বা এরকম বড় কোনো অনুষ্ঠানে একসময় ডেকোরেটর থেকে প্লেট ভাড়া করেই বেশি আনা হতো। এখন দেখি সেখানে প্লাস্টিকের থালা, গ্লাসের ব্যবহার করা হয়। 

তারপর অনুষ্ঠান শেষে পাশের কোনো ডোবায় ফেলে দেয়া হয়। এভাবেই চলছে শহর থেকে গ্রামে। কিন্তু এর ফল একবারও কি কেউ ভেবে দেখছি? এসব ওয়ান টাইম প্লাস্টিকের গতি শেষ পর্যন্ত কি হচ্ছে? বেশিরভাগ মানুষই এ ব্যাপারে পুরোমাত্রায় অসচেতন। আর এ কারণেই সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার না কমে বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে। আমরা পরিবেশ রক্ষা করতে চাই না পরিবেশ ধ্বংস করতে? ভবিষ্যতের পৃথিবী পরিচ্ছন্ন, টেকসই হবে না মানব জাতির জন্য ধ্বংসাত্মক হবে?

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট