
অর্থনৈতিক সংকটের মুহূর্তে একটি দেশের সামনে দুটো পথ খোলা থাকে—কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া অথবা মায়াবী গল্প শোনানো। ঘোষিত ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেট দেখে স্পষ্ট, বাংলাদেশ সরকার পরবর্তী পথটাই বেছে নিয়েছে। বাজেটের আকার শুনতে বড়। ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এই বিশাল অঙ্কের নিচে যে অর্থনৈতিক কাঠামোটা আছে, তা দূর্বল, ভঙ্গুর এবং বাস্তবতা থেকে ছিন্ন। এই বাজেট উন্নয়নের পথনির্দেশ নয়, এটি হলো অর্থনৈতিক অচলাবস্থার সুনির্দিষ্ট রূপরেখা।
আমার কাছে এটি বাস্তব মূল্যমান অনুযায়ী সংকুচিত এক বাজেট। যদিও বাজেটের পরিমাণ গত বছরের তুলনায় সামান্য কম, কিন্তু ৯ শতাংশের উপরে অবস্থান করা মুদ্রাস্ফীতির প্রেক্ষাপটে এটি প্রকৃত অর্থে ১০ শতাংশেরও বেশি সংকুচিত হয়েছে। এমন সময়ে যখন রাষ্ট্রের প্রসারিত ব্যয় প্রয়োজন ছিল, তখন এই সংকোচন দেশের সামর্থ্যকে খণ্ডিত করে দিচ্ছে।
সরকারি ব্যয় এখন জিডিপির ১২ দশমিক ৭ শতাংশ, যেখানে ভারত ব্যয় করে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ, পাকিস্তান ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ভিয়েতনাম ২০ শতাংশ। অর্থনীতিতে জিডিপির তুলনায় বাজেটের আকার হচ্ছে রাষ্ট্রের উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের এই হ্রাসপ্রাপ্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা এক ধরণের আত্মসমর্পণ।
রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার এক অবাস্তব কল্পনা বলে আমি এবারের বাজেটকে বিবেচনা করি। ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা যে নিছক কল্পনা, তা বলা বাহুল্য। বিগত ১২ বছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কখনোই কোনো লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি, অথচ এবারও কোনো মৌলিক সংস্কারের উদ্যোগ নেই।
কোনো ডিজিটাল ট্যাক্স ব্যবস্থা নেই, ভ্যাট সংগ্রহে প্রযুক্তির ব্যবহার নেই, ই-ফাইলিং ব্যবস্থা নেই, কর কাঠামো সংস্কারের সময়রেখা নেই—কিছুই নেই। দেশে যেখানে মাত্র দেড় মানুষ আয়কর দেয়, সেখানে এমন উচ্চাকাঙ্ক্ষী রাজস্ব লক্ষ্য হাস্যকর। এটি উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়, আত্মপ্রবঞ্চনা।
বাজেটে আমি কথায় কল্যাণ দেখছি, যেখানে কাজ উপেক্ষিত হয়েছে। সরকার ‘জনবান্ধব’ বাজেটের কথা বললেও বরাদ্দের চিত্র ভিন্ন। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ লজ্জাজনক। যেমন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত। স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার সুরাপরিশ হল এক সপ্তমাংশ।
শিক্ষা খাতের অবস্থা অবশ্য স্বাস্থ্যের চেয়ে একটু ভালো। এখানে বরাদ্দ এক দশমিক ৫৪ শতাংশ। অথচ ইউনেস্কোর সুপারিশ শিক্ষায় চার থেকে ছয় শতাংশ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। উল্টো দিকে অস্বচ্ছ খাতে অনেক বেশী বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যেমন প্রতিরক্ষা ব্যয় দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া ঋণ পরিশোধে খরচ হচ্ছে মোট আয়ের ২২ শতাংশ, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এটা পরিষ্কার যে সরকার জনগণের ক্ষমতায়নের চেয়ে নিজের অস্ত্রাগার রক্ষা করতে বেশি আগ্রহী।
উন্নয়নে সংকোচনের পাশাপাশি ভবিষ্যতের বিনিয়োগে ছুরি কাঁচি চালানো হয়েছে। বিস্ময়কর হল, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি কমে গেছে ১৩ শতাংশ। আসছে অর্থ বছরের জন্যে নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে মাত্র ২৬টি। আমরা যেখানে এডিপি’র খরচ কমাচ্ছি সেখানে ভারত ১১ শতাংশ বাড়িয়েছে। আর কথায় কথায় তুলনা করি যে ভিয়েতনামের সঙ্গে তারা উন্নয়ন ব্যয় বাড়িয়েছে ১০ শতাংশ। আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের এই সংকোচন ভবিষ্যতের উন্নয়নের দুয়ার বন্ধ করছে। এটি আর্থিক দুর্বলতার চিহ্নই নয়, দূরদর্শিতার অভাবও স্পষ্ট।
ঋণের ফাঁদ এবং অদৃশ্য মৃত্যুকূপে যেন আমরা আটকে গেছি। ঘাটতি পূরণের জন্য বাজেটের প্রায় অর্ধেক অর্থ দেশের ব্যাংকগুলো থেকে ধার নেওয়া হবে। এর ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ সংকুচিত হবে, সুদের হার বাড়বে, এবং এসএমই খাত অর্থ সংকটে পড়বে—যা কর্মসংস্থান ও উদ্ভাবনের প্রধান চালিকাশক্তি।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে রয়েছে অথচ বিনিময় হার নীতিতে কোনো সংস্কার নেই। এই ‘ম্যানেজড ফ্লোট’ ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়, বরং বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে। এই বাজেট স্পষ্টভাবে আইএমএফ-এর শর্ত লঙ্ঘন করেছে। ভাসমান বিনিময় হার, কর আদায় বৃদ্ধির পদক্ষেপ, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সংস্কার—এসবের কিছুই নেই। ফলে পরবর্তী কিস্তির অর্থ ছাড় আটকে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। এটি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতির ঝুঁকি নয়—আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
সংস্কারের পথে হাঁটতে হলে বাস্তবভিত্তিক একটি পরিকল্পনা দরকার বলে আমি মনেকরি। প্রযুক্তি ও ফিনটেক খাতের একজন মানুষ। একই সঙ্গে একজন পেশাজীবীও বটে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমি পাঁচটি সুপারিশ দিতে চাই। আমার প্রথম সুপারিশ হবে – আগামী ২৪ মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল কর আদায় ব্যবস্থা চালু করা। দ্বিতীয়ত - স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় যথাক্রমে ২ শতাংশ ও ৩ শতাংশ জিডিপি বরাদ্দ দেওয়া। তৃতীয়ত – যে অবকাঠামোগুলোতে আমাদের লাভের সম্ভাবনা বেশী সেগুলোকে অগ্রাধিকার তালিকায় নিয়ে বরাদ্দ দেওয়া। আমি চার নম্বরে রাখছি, স্বচ্ছ ঋণ ও সুদের হার নীতি প্রণয়ন এবং শেষে যে দাবিটি রাখবো সেটি হল - প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের বাজেটকে কার্যসম্পাদনের সঙ্গে যুক্ত করা।
এ কাজগুলো করলে বাজেট খরচের বিপরীতে জনগনের সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে। আর কাজগুলো ঠিক মতো না হলে বাজেট ‘উন্নয়নশীল বাংলাদেশের রূপরেখা’ নয় বরং পতনের দিনলিপি হয়ে যাবে। বাজেট অপরিবর্তিত থাকলে এটি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধ্বংস করবে, বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করবে, এবং সামাজিক অস্থিরতা বাড়াবে।
আমি মনেকরি, ১৭ কোটি মানুষের দেশ কেবল বিভিন্ন সংখ্যার জালে আটকে থাকতে পারে না। এখনই সময়—নির্ভীক সংস্কারকে গ্রহণ করার, আত্মপ্রবঞ্চনা পরিত্যাগ করার। আমরা চাই - জবাবদিহি ও সাহসী পরিবর্তন।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, রেগটেক এবং প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, নগদ।
Comments