Image description

আচ্ছা, আপনি কেমন বোধ করবেন যদি আপনি আগামীকাল সকালে ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজে দেখতে পান যে, এখন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তিতে ভর্তি পরীক্ষার পরিবর্তে লটারির আয়োজন করা হবে? অর্থাৎ, লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হবে? আপনার কাছে নিশ্চয়ই ধারণাটি অস্বাভাবিক লাগবে। একজন শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিক হিসেবে কিছুটা হলেও আপনি বিস্মিত হবেন। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটা দেশের সবচেয়ে মেধাবীদের জায়গা। আর লটারির মাধ্যমে মেধাবীদের বাছাই করা যায় না। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এমনটি কখনো না ঘটলেও বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় এমনটি ঘটেছে ২০২০ সালে। আর সেই থেকে এমন আজব নিয়ম এখনো চালু আছে শিক্ষার অতি গুরুত্বপূর্ণ এই স্তরে।

২০২০ সালে করোনা ভাইরাস নামক একটা অতিমারী সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লে মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমসহ সব ধরনের কার্যক্রম ব্যাহত হয়। মানুষ অফিসের কাজ করবে কি, ঘরের বাইরেই বের হতে পারে না। এতে করে গোটা মানব সমাজেই একটা বিরাট স্থবিরতা নেমে আসে। বাংলাদেশও সেই অতিমারির ছোবলে ক্ষতবিক্ষত হয়। দেশের সকল প্রতিষ্ঠান কার্যত অচল হয়ে পড়ে। 

সবাইকেই তখন বাধ্যতামূলক সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হয়। দেশের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের মতো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও তাদের কার্যক্রম অতি সীমিত আকারে নামিয়ে আনে। এরই একটি ছোট্ট উদাহরণ হচ্ছে, মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার্থী ভর্তির নিমিত্তে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ভর্তি পরীক্ষা প্রথার পরিবর্তে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করার সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্তটি সেসময় তুমুল বিতর্কের জš§ দিলেও তখনকার পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশের আপামর জনসাধারণ সেটা মেনে নিয়েছিল।

আলোচনার শুরুতেই আভাস দিয়েছিলাম যে, দেশের সবচেয়ে মেধাবীরাই দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে পড়বে। এটাই বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত প্রথা। কারণ, একমাত্র শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠগুলোই পারে দেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবীদের লালন-পালন করতে, জ্ঞান বিতরণ করতে। একমাত্র শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠগুলোতেই মেধার মূল্যায়নের যথার্থ অবকাঠামো ও সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া, একজন অসম্ভব মেধাবী শিক্ষার্থীর মধ্যকার সুপ্ত মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে তার চারপাশে মেধাবী মানুষদের বলয় তৈরি করে দিতে হয়। আর এ ধারণা থেকেই কিন্তু আজকের বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি। 

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী যতটুকু না তার শিক্ষকদের কাছ থেকে শেখে, তার চেয়ে বেশি শেখে তার সহপাঠীদের কাছ থেকে। এখন যদি রাষ্ট্রের উপর পর্যায়ের জরুরি এক সিদ্ধান্তে ঘোষণা করা হয় যে, দেশের সকল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তিতে আর ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হবে না, বরং তার পরিবর্তে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হবে, তাহলে কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সর্বজনীন ধারণাটিই আর বহাল থাকে না। এমন হটকারী সিদ্ধান্ত চালু হলে কিন্তু আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যশোর এম. এম. কলেজের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। 

পৃথিবীর সকল দেশে এমন হাস্যকর সিদ্ধান্ত বহাল থাকলে কিন্তু আজ অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, স্ট্যানফোর্ড, এমআইটি’র মতো পৃথিবীর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মানুষকে আর আলাদা করে জানার দরকার পড়ত না। এসব প্রতিষ্ঠানে পৃথিবীর সেরা সেরা শিক্ষার্থীরা ভর্তির সুযোগ পায় বলেই এরা পৃথিবীর সেরা গ্র্যাজুয়েট বের করতে পারে এবং এ কারণে তারা বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করে। এখন যদি হঠাৎ করে এসব পৃথিবী বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়, আর সেই লটারির মাধ্যমে যদি মোট শিক্ষার্থীর মাত্র পাঁচ বা দশ শতাংশ মেধাবী শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পায়, তাহলে বাকি পঁচানব্বই বা নব্বই শতাংশ মেধাহীন শিক্ষার্থীর ভিড়ে এই অল্প কতক মেধাবীও কিন্তু জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র থেকে ছিটকে যায়। এজন্য একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর সাথে আর একজন মেধাবী শিক্ষার্থীকে রেখে জ্ঞান চর্চার পথকে আরো সুগম করতেই বিশ্ববিদ্যালয় নামক ধারণার সূচনা হয়। 

দেশের উচ্চ শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো মাধ্যমিক পর্যায়েও কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলোকে বলা হয়ে থাকে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের আঁতুড়ঘর। মাধ্যমিক পর্যায়ের এসব খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন আছে, তেমনি আছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল, ঢাকা, ধানমন্ডি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, আজিমপুর সরকারি বালক ও বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, মতিঝিল সরকারি বালক ও বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, দেশের সকল বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের সরকারি হাই স্কুল ইত্যাদি। 

মাধ্যমিক পর্যায়ের খ্যাতনামা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল, আইডিয়াল স্কুল, সেন্ট জোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সেন্ট গ্রেগরি উচ্চ বিদ্যালয়, হলিক্রস গার্লস হাই স্কুল, রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল ইত্যাদি। মাধ্যমিক পর্যায়ের এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এ যাবত বহু জ্ঞানী-গুণী মানুষ তৈরি হয়েছে। কারণ, দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদেরকে জ্ঞান বিতরণ ও জ্ঞান চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর রয়েছে সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও শিক্ষার সহায়ক পরিবেশ।

একটি দেশ বা জাতির মধ্যে অগণিত মেধাবী সন্তানের জন্ম হয় না। জন্মগত মেধাবীর সংখ্যা সবকালেই এবং সব দেশেই খুব সীমিত থাকে। আর একটা দেশ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে চালাতে এই অল্পসংখ্যক মেধাবীদের সুষ্ঠু ও সুন্দর শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারাই যথেষ্ট। কিন্তু, এসব মেধাবী সন্তানদের দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষিপ্তভাবে ছেড়ে দিলে তাদের মেধার যথার্থ বিকাশ ঘটবে না। বরং এসব মেধাবী শিক্ষার্থী যাতে এক জায়গায় জড়ো হতে পারে এবং একে অপরের বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তা-ভাবনা আদান-প্রদান করতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এ লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে প্রয়োজনে আরো ভালো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেতে পারে। কিন্তু, শিক্ষার্থী ভর্তিতে লটারির মতো কালাকানুন করে দেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মেধাবীদের মেধা নষ্টের পরিকল্পনা জাতির জন্য শুভ কোনো খবর বয়ে আনবে না।

লেখক:  শিক্ষক ও কলামিস্ট।


মানবকণ্ঠ/এফআই