Image description

‘জুলাই বললে লাল হয়ে যায় স্মৃতি/গণবিদ্রোহ, প্রত্যেক দিন লাশ/মুক্তি-অথবা-মৃত্যুর প্রস্তুতি/জুলাই দীর্ঘ, ৩৬ দিনে মাস।’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন কবিতায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে স্মরণ করেছেন এভাবেই। আসলে বিপ্লবীদের কাছে ‘জুলাই’ নিছক একটি মাসের নাম নয়, বরং প্রবল হৃদয়াবেগে উচ্চারিত সকরুণ আর্তকণ্ঠ। গাঢ় গভীর অস্ফুটে মর্মন্তুদ দুঃখবোধ। যেখানে গণদ্রোহ, দৃঢ়চেতা সাহস, মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানো মানবিক সত্তা জাগ্রত হয়েছে দেশ ও জাতির স্বার্থে। বাঙালির ইতিহাসে যোগ করেছে নতুন মাত্রা।

আজ সেই ৫ আগস্ট। জুলাই গণঅভুত্থানের চূড়ান্ত বিজয়ের দিন। ছাত্র-জনতার বিপ্লব আর বিদ্রোহের দাবানলে এদিন ছাড়খাড় হয়ে যায় শেখ হাসিনার মসনদ। পতন ঘটে তার সরকারের। দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন তিনি। ঐতিহাসিক এই বিপ্লবের বিজয়ের দিনটিকেই ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে আজ পালন করবে জাতি। মূলত বিজয়ের ধারার সূচনা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এটি পরে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে আরও প্রবল হয়ে উঠেছিল যা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। 

গত বছরের ৫ আগস্ট দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ কারফিউ অমান্য করে রাজধানীর কেন্দ্রে একত্রিত হয়। ‘মার্চ টু ঢাকা’ ডাকে সাড়া দিয়ে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের স্রোত রাজধানী অভিমুখে ধাবিত হয়। দুপুর নাগাদ ভিড় করে শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবনে। জনসাধারণ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে, জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করার সাথে সাথে ঢাকা  জুড়ে উদযাপনের কুচকাওয়াজ শুরু করে। 

অবশ্য তার কিছু সময় আগেই শেখ হাসিনা তার বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে সামরিক বিমানে করে ভারতে পালিয়ে যান। সেই দিন, জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা ঘোষণা দেন এবং সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে সকল হত্যার তদন্তের প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানান এবং পরে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন বঙ্গভবনে বিএনপি ও জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন।

অহিংস আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয় শেখ হাসিনার মন্তব্যে: শুরুতে চাকরি প্রত্যাশীদের এ আন্দোলন ছিল অহিংস। কিন্তু জুলাইয়ের ১৫ তারিখ থেকে তা সহিংস হয়ে উঠতে থাকে। এর ২০ দিনের মাথায় রাষ্ট্রীয় বাহিনী আর সরকার দলীয় বাহিনীর অবিশ্বাস্য নৃশংসতায় বিপুল প্রাণ আর রক্তের বোঝা মাথায় নিয়ে পতন হয় শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের। 

শিক্ষার্থীদের ঘোষণা ছিল, রক্তিম এ জুলাইতেই হাসিনার পতন নিশ্চিত করবে তারা। যে কারণে ৩১ জুলাইয়ের পর থেকে নতুনভাবে তারিখ গণনা শুরু করতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। সে হিসেবে পতন নিশ্চিত হওয়ার পর ফ্যাসিস্ট হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট ছিল ‘৩৬ জুলাই’। প্রলম্বিত এ জুলাইয়ের ১৪ তারিখ চীন ফেরত শেখ হাসিনার সেই আলোচিত সংবাদ সম্মেলন থেকে তার পতন পর্যন্ত কালক্রমিক ঘটনার স্মৃতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে মানবকণ্ঠ। 

আগের দিন ২০২৪ সালের ১৩ জুলাই শনিবার সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেয়ার কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেছিলেন, বিচারাধীন বিষয়ে সরকারের কিছু করার নেই। ঘোষণা অনুসারে ১৪ জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিয়ে আন্দোলনকারীরা জাতীয় সংসদে জরুরি অধিবেশন ডেকে সরকারি চাকরির সব গ্রেডের কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন। এর মধ্যে ওই দিন সন্ধ্যায় গণভবনে চীন সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘একবার এ ধরনের আন্দোলন করল। শুধু আন্দোলন না, আওয়ামী লীগ অফিসে আক্রমণ, মানুষের ওপর আঘাত। দেশের জ্ঞানী-গুণী আছে, ঘরের ভেতরে বসে মিথ্যা-অপপ্রচার রেকর্ড করে ছাড়ল। এগুলো দেখে বিরক্ত হয়ে বললাম, ঠিক আছে কোটা বাদই দিলাম। সেটার উদ্দেশ্য ছিল কোটা বাদ দিলে কী হয় (সেটা দেখা)? সেই কোটা বাতিলে মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করেছেন। 

মামলার পরে কোর্ট কোনো রায় দিলে সে বিষয়ে নির্বাহী বিভাগের কিছু করার নেই। সেখানেই সমাধান করতে হবে। আদালত তাদের সুযোগ দিয়েছে। তারা আদালতে যাক, বলুক। সেটি না করে, তারা রাজপথে সমাধান করবে। আমাকে বলছে। আদালত যখন কথা বলেছে, রায় হয়ে গেছে, সেই রায়ের বিরুদ্ধে আমার তো দাঁড়ানোর অধিকার নেই, সংবিধানও বলে না, সংসদও বলে না, কার্যপ্রণালি বিধিও বলে না, কিছুই না। যতক্ষণ পর্যন্ত আদালত থেকে সমাধান না আসবে ততক্ষণ আমাদের কিছু করার থাকে না। এ বাস্তবতা তাদের মানতে হবে। না মানলে কিছুই করার নেই।’ 

‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’: সংবাদ সম্মেলন থেকে আসা এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সেদিনই রাত ১০টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হলে বিক্ষোভ শুরু হয়। পরে মধ্যরাতে শিক্ষার্থীরা জড়ো হন টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে। রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে জড়ো হয়ে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী নানা স্লোগান দেন। সেখানে নারী শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। 

জমায়েতে শিক্ষার্থীরা ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার; কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’সহ নানা স্লোগান দেন। একই সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করলে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। হামলা হয় জাহাঙ্গীরনগর ও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের ওপরেও। রাতে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে বের হতে শুরু করলে হলগুলোর ফটকে অবস্থান নেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। 

কয়েকটি হলের ফটকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের আটকে রাখেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী টিএসসিতে আসেন। এমন পরিস্থিতিতে ভোরে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ঘোষণা দেন, প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন থেকে আসা বক্তব্য দুপুর ১২টার মধ্যে প্রত্যাহার না করলে তারা আন্দোলনে নামবেন। কিন্তু সরকার শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে না নেয়ায় চূড়ান্ত অন্দোলনের পথে হাঁটা শুরু হয়। 

যেভাবে হয় সর্বাত্মক আন্দোলন: ১৩-১৮ জুলাইয়ে আন্দোলন অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়লে ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে লেলিয়ে দেয় সরকার। তারা সশস্ত্র আক্রমণ করে আন্দোলন বন্ধ করার চেষ্টা করে। ১৪ জুলাই রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলায় আহত হয় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীরা বিচারের দাবিতে উপাচার্যের বাসভবনে প্রবেশ করলে তাদের অবরুদ্ধ করে বহিরাগত সন্ত্রাসী এনে পুনরায় সশস্ত্র ও সর্বাত্মক হামলা চালায় সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ। 

মুহুর্মুহু পেট্রোল বোমা, ককটেল, কাচের বোতল নিক্ষেপ করে রাতভর হামলা চালিয়ে বাসভবনকে রণক্ষেত্রে পরিণত করে ছাত্রলীগ। সরকারের পুলিশ বাহিনী সেখানে নীরব ভূমিকা পালন করে। শেষরাতে শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক প্রতিরোধের মুখে ক্যাম্পাস ছেড়ে পালিয়ে যায় ছাত্রলীগ। সারা বাংলাদেশে প্রথম সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ মুক্ত হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এই ঘটনায় উজ্জীবিত হন শিক্ষার্থীরা। পরদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ মুক্ত হয়। ১৮ জুলাই পুলিশের গুলিতে নৃশংসভাবে শহিদ হন আবু সাঈদসহ একাধিক শিক্ষার্থী। ক্ষোভে ফেটে পড়ে জনগণ। কোটাবিরোধী আন্দোলন পরিণত হয় সর্বাত্মক ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তথা গণঅভ্যুত্থানে।

শোকের কালো রঙ হয়ে যায় লাল: এত অল্প সময়ে কোনো আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিতে পারে এ ভাবনা ছিল সবার কল্পনাতীত। যখন শেখ হাসিনা সরকার শোক দিবসে সবাইকে কালো রঙ ব্যবহার করার নির্দেশ দিল, তখন দারুণ কুশলতায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা দিলেন বিপ্লবের লাল রঙে প্রোফাইল রাঙানোর ডাক। আর তাতে সাড়া দিয়ে কোটি মানুষ ফেসবুকের মতো মিডিয়ার নীল ফিডকে লালে লাল বানিয়ে ফেলে।

বারুদ হয়ে ওঠে স্লোগানগুলো: বিশ শতকের শুরুর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত সেøাগান ছিল ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। ২০১৮ সালের সড়ক আন্দোলনের ‘যদি তুমি ভয় পাও/তবে তুমি শেষ/যদি তুমি রুখে দাঁড়াও/তবে তুমিই বাংলাদেশ’ সেøাগানও তুমুলভাবে আলোড়িত করেছে মানুষের মন। কিন্তু চব্বিশের অভ্যুত্থানের স্লোগানগুলো প্রতিটিই বারুদ হয়ে ওঠেছিল। গণবিদ্রোহের ইতিহাসে অনন্য এই জেন-জির অভ্যুত্থানের স্লোগানগুলো। 

কোটা সংস্কারের দাবি থেকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিতে নিতে বদলে গেছে আন্দোলনের দাবি, মিছিলের সেøাগান ও অভ্যুত্থানের ভাষা। আন্দোলনের শুরুতে স্লোগান ছিল, ‘কোটা না মেধা? মেধা, মেধা’ কিংবা ‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’। ১৫ জুলাই রাতে শেখ হাসিনা যখন আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চাদের সঙ্গে তুলনা করলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বদলে যায় তাদের স্লোগানের ভাষা। তারা স্লোগান দিতে থাকে ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার।/কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’। এছাড়া ‘চাইলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’! 

আন্দোলনকারীরা আরও স্লোগান দিতে থাকে ‘লাখো শহীদের দামে কেনা/ দেশটা কারও বাপের না’। ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরস্ত্র শিক্ষার্থী আবু সাঈদ শহীদ হলে স্লোগানের মেজাজও বদলাতে থাকে। আন্দোলনকারীরা স্লোগান দেন, ‘আমার খায়, আমার পরে,/ আমার বুকেই গুলি করে’। ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়/ বুক পেতেছি গুলি কর’। 

‘তোর কোটা তুই নে,/আমার ভাই ফিরিয়ে দে’। ‘লাশের ভিতর জীবন দে/ নইলে গদি ছেড়ে দে’। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারের আপসের সমস্ত সম্ভাবনা বিলীন হতে শুরু করলে স্লোগান ওঠে ‘আপস না সংগ্রাম?/ সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘দালালি না রাজপথ?/ রাজপথ, রাজপথ’। ধীরে ধীরে মৃত্যুর মিছিল বাড়তে থাকে। আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার ক্ষোভও বাড়তে থাকে। স্লোগান ওঠে, ‘এক দফা, এক দাবি/ স্বৈরাচার তুই কবে যাবি’। ‘ঢাকায় আসো জনতা,/ ছাড়তে হবে ক্ষমতা’। সবশেষ ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পালানোর পর পর থেকেই সেøাগান ওঠে ‘পালাইছে রে পালাইছে,/ হাসিনা পালাইছে’। 

শব্দ আর রঙের জ্বালাময়ী প্রতিবাদ গ্রাফিতিতে: ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় ভিন্নমত দমন, অদৃশ্য ভয় আর স্ব-আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আন্দোলনে ছাত্র-জনতার মুখপাত্র হয়ে উঠেছিল দেয়াল, সমতল থেকে পাহাড়, সর্বত্র। আন্দোলনে প্রবলভাবে শামিল হয়েছিল পুরো দেশের দেয়ালজুড়ে আঁকা গ্রাফিতি। বহুদিনের অনুচ্চারিত ক্ষোভ যেমন ভাষা পেয়েছে, তেমনি গ্রাফিতিসহ পোস্টার, র?্যাপ ইত্যাদি আন্দোলনের একরকম নতুন ভাষার জন্ম দিয়েছে।

২০২৪ সালের ২৭ জুলাই বিকাল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরপাকড় আর হামলায় ছত্রভঙ্গ আন্দোলনকারীরা খুঁজে নেয় এক নতুন প্রতিবাদের ভাষা- গ্রাফিতি। কেবল রাজধানী নয়, সারাদেশ জুড়েই দেয়ালে ফুটে ওঠে শব্দ আর রঙের জ্বালাময়ী প্রতিবাদ। ‘শিক্ষা-ছাত্রলীগ, একসঙ্গে চলে না, ভয়ের দেওয়াল ভাঙলো, এবার জোয়ার এলো ছাত্র-জনতার, কারার ঐ লৌহকপাট- এমন শত শত স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে দেয়াল। 

শিক্ষার্থীরা হাতে তুলে নেয় রঙতুলি, বুকভরা সাহস আর চোখে প্রতিবাদের আগুন। দেয়ালে আঁকা হয় গুলির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আবু সাঈদের রক্তাক্ত মুখ। শুধু ছবি নয় তা হয়ে ওঠে এক ইতিহাসের প্রতীক। গ্রাফিতির রঙে রঙে ফুটে উঠেছিল একটাই বার্তা- এই দেশ আর আগের মতো থাকবে না। পরিবর্তন আসবেই।

শাসকদের জন্য ছিল বার্তা: জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশকে তার পুরোনো ইতিহাসের শক্তি মনে করিয়ে দিয়ে গেছে। শাসক যত শক্তিমানই হোক না কেন, দেশের মানুষ অবিভাজ্য রাজনৈতিক সত্তা হয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়ালে, নিজেদের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করলে ইতিহাস বদলে দিতে পারে যেমন ঘটেছিল ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১ ও ১৯৯০ সালে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান দেশের মানুষকে জানিয়ে দিয়ে গেছে, এই রাষ্ট্রের তারাই মালিক, তারাই জিম্মাদার। বার্তা শুধু মানুষের জন্যই ছিল না, ছিল শাসকদের জন্যও। স্বৈরাচারী শাসকের কর্তৃত্ব যতই কঠিন হোক, নিষ্ঠুরতা যতই সীমাহীন হোক, গণজোয়ারের মুখে তারা খড়কুটোর মতো ভেসে যেতে বাধ্য।