Image description

বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার আগের দিন রোববার ঠান্ডাজনিত অসুস্থতায় স্কুলে অনুপস্থিত ছিল সাদ সালাহ উদ্দিন (৯)। ঘটনার দিন সোমবার কান্নাকাটি করে স্কুলে গিয়েছিল সে। কারণ, স্কুল ছিল তার প্রিয় জায়গা। সহপাঠী-বন্ধুরা ছিল প্রিয়। ভয়াবহ আগুনে সেই বন্ধু-সহপাঠীদের সঙ্গেই সাদের ছোট্ট প্রাণ ঝরে পড়ল। মর্গে সাদের হাতে পরা লাল রঙের ঘড়ি দেখে বাবা সালাহ উদ্দিন মুকুল নিশ্চিত হয়েছিলেন, এটিই তাঁর সন্তান। সাদ মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলা মাধ্যমে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ত। বিমানটি সাদদের শ্রেণিকক্ষের ওপর আছড়ে পড়েছিল।

সাদের দাদা ও নানাবাড়ি মুন্সিগঞ্জে। দিয়াবাড়িতে পরিবারটি ভাড়া বাসায় থাকে। সাদের শোকার্ত মা–বাবাকে সন্তান নিয়ে প্রশ্ন করতে মানা করেছিলেন পরিবারের সদস্যরা। সাদের বাবা নিজ থেকে কথা বলার আগপর্যন্ত কথা হয় স্বজনদের সঙ্গেই। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার চার ঘণ্টার বেশি সময় পর রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) মর্গে গিয়ে সাদের মরদেহের খোঁজ পাওয়া যায়। এর আগে কয়েকটি হাসপাতালে ছোটাছুটি করেছিলেন পরিবারের সদস্যরা। ওই সময় সাদের মা–বাবার সঙ্গে ছিলেন একমাত্র ফুফা আবু সাঈদ মিলন।

আবু সাঈদ বলেন, সাদের বাবার অফিসের বস তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িটি সাদকে খোঁজার জন্য দিয়েছিলেন। সেটিতে চড়ে তাঁরা হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরছিলেন। সিএমএইচে রোগীদের মধ্যে না পেয়ে সাদের মা–বাবাকে গাড়িতে রেখে তিনি সাদের ছবি নিয়ে মর্গে যান। সেখানে তাঁকে জানানো হয়, তিনটা লাশ রয়েছে। তবে তিনি শিশুর ফুফা জানার পর মর্গের দায়িত্বরত ব্যক্তি বলেন, একমাত্র মা–বাবা ছাড়া কারও লাশ শনাক্ত করার অনুমতি নেই। বাধ্য হয়ে তিনি গাড়ির কাছে ফিরে এসে সাদের বিপর্যস্ত বাবাকে নিয়ে মর্গে যান। মর্গ থেকে ছেলের পরনে কী কী ছিল, তার বর্ণনা চাওয়া হয়। তিনি বর্ণনা দেন। সে বর্ণনা মিলে যাওয়ায় তাঁকে লাশ দেখানো হয়। হাতে লাল রঙের ঘড়ি আর পরনে নেভি ব্লু আন্ডারপ্যান্ট ছিল সাদের। সেটি দেখার পর বাবা নিশ্চিত হন, এটি সাদ-ই।

সিএমএইচ কর্তৃপক্ষ কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষে ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ হস্তান্তর করে রাত ১০টার দিকে। রাত ১১টার দিকে বাসার নিচে জানাজা শেষে সাদকে সমাহিত করা হয় মিরপুর সাড়ে ১০ নম্বরে অবস্থিত কবরস্থানে। সেখানে সাদের দাদাও সমাহিত হয়েছিলেন।

আলাউদ্দিন টুটুল বলেন, সকালে অফিসে যাওয়ার সময় সাদকে ওর বাবা স্কুলে নিয়ে যেতেন। বেলা একটার সময় ক্লাস শেষ হতো। দেড়টার সময় কোচিং শুরু হতো। এই ৩০ মিনিটের বিরতিতে দুপুরের খাবার খেয়ে নিত শিশুরা। যখন বিমান বিধ্বস্ত হয়, তখন শিশুরা দুপুরের খাবার খাচ্ছিল। কথা বলার এক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ বিমান কীভাবে লোকালয়ে ওড়ার অনুমতি পায়, তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

ওই সময় সোফায় বসে থাকা সাদের বাবা সালাহউদ্দিন মুকুল প্রথম কথা বলেন। তাঁর কণ্ঠে ঝরে পড়ছিল ক্ষোভ। তিনি বলেন, ‘এভাবে যদি প্রশিক্ষণ বিমান না উড়ত, তাহলে আমার সন্তান আজ মারা যেত না, কারও সন্তানকে মরতে হতো না। আমার ছেলের গল্প লেখার দরকার নেই। যদি রিপোর্ট করেন, তাহলে কারা দায়ী, তাদের কথা লেখেন। তাদের বিচারের আওতায় আনার ব্যবস্থা করেন। তাহলে বুঝব, আপনারা কিছু করেছেন।’

সালাহউদ্দিনের ক্ষোভ কমছিল না। তিনি বলছিলেন, ‘স্কুলে গিয়ে যখন দেখি বিমানটা আমার ছেলের ক্লাস রুমে পড়েছে, তখনই বুঝেছি, আমার ছেলে নেই। আমার ছেলের ক্লাসের একজন চিপস কিনতে বের হয়েছিল, আরেকজন খাবার খেতে বাইরে বের হয়েছিল। ওই দুজন ছাড়া কেউ বেঁচে নেই। আমার ছেলে বেঁচে নেই। ওর বন্ধুরা বেঁচে নেই। মৃত্যুর সংখ্যা এত কম হতে পারে না। ভুয়া মৃত্যুর তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। অনেক শিশু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমাদের সন্তানদের শহীদের মর্যাদা দিতে হবে, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে হবে।’ কথাগুলো বলে আবার চুপ করে গেলেন এই বাবা।