
গত বছরের ৫ আগস্ট ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে অন্তত ৫২ জন নিহত হন। এই ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ পুলিশি সহিংসতার একটি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিবিসি আই-এর এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরও এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল।
বিবিসির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে, শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে টানা ৩৬ দিনের বিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়ার দিনই যাত্রাবাড়ীতে এই ব্যাপক সহিংসতা ঘটে। সংস্থাটি শত শত ভিডিও, ছবি, প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শনের মাধ্যমে নিহতদের এই সংখ্যা নিশ্চিত করেছে। যদিও জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে ঘটনাটি নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়েছিল, বিবিসির এই অনুসন্ধানে হত্যাকাণ্ডের শুরু ও শেষ এবং হতাহতের সংখ্যা সম্পর্কে নতুন ও বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে প্রাপ্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিডিওতে ৫ আগস্ট বিকেলে যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিবর্ষণ শুরুর মুহূর্তগুলো দেখা যায়। এই ভিডিওটি মিরাজ হোসেন নামের একজন আন্দোলনকারীর মোবাইল ফোন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে, যিনি নিজেও সেদিন পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
ভিডিও বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুপুর ২টা ৪৩ মিনিটে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ সদস্যরা ফটকের সামনে থাকা বিক্ষোভকারীদের ওপর আকস্মিকভাবে গুলি চালায়। থানার উল্টো দিকের একটি ভবনের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, পুলিশ গুলি শুরু করার পর বিক্ষোভকারীরা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যাচ্ছে। আরেকটি ভিডিওতে পুলিশকে আহতদের শরীরে লাথি মারতেও দেখা যায়। মিরাজের ভিডিওটি হত্যাকাণ্ডের সূত্রপাত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিয়েছে এবং এটি নিশ্চিত করেছে যে, পূর্বে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও, যা ৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের বলে দাবি করা হচ্ছিল, সেটি আসলে অন্য কোনো দিনের ঘটনা ছিল।
বিবিসির অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ৫ আগস্ট বিকেলে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে হত্যাকাণ্ড চলেছিল। কিছু ড্রোন ভিডিওর মেটাডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিকেল ৩টা ১৭ মিনিটেও যাত্রাবাড়ী থানার সামনের মহাসড়কে বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ গুলি চালাচ্ছিল। ড্রোন ভিডিওতে মহাসড়কের ওপর হতাহতদের একাধিক মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। আন্দোলনকারীরা ভ্যান-রিকশা এবং বাইকে করে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরবর্তী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ শাহবাগের দিকে চলে যায়। যারা তখনও যাত্রাবাড়ীতে ছিলেন, তাদের মধ্যে বিক্ষুব্ধ একটি অংশ থানায় আগুন দিলে কমপক্ষে ছয়জন পুলিশ সদস্য নিহত হন।
প্রাথমিকভাবে ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে অন্তত ৩০ জন বিক্ষোভকারী নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর, নিহতদের পরিবারের সাক্ষাৎকার, হাসপাতালের নথি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন পোস্ট যাচাই করার পর বিবিসি নিশ্চিত করেছে যে, ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে কমপক্ষে ৫২ জন সাধারণ মানুষ নিহত হন। এর বাইরে সেদিন আরও অন্তত ছয়জন পুলিশ নিহত হয়েছিলেন।
শেখ হাসিনার একটি ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিং থেকে জানা গেছে, গত বছরের আন্দোলনে প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের অনুমতি তিনি নিজেই দিয়েছিলেন। বিবিসির যাচাই করা ওই রেকর্ডিং অনুসারে, শেখ হাসিনা তার নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে তারা যেখানেই আন্দোলনকারীদের পাবে, সেখানেই গুলি করবে। এই অডিওটি শেখ হাসিনা সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের গুলি করার জন্য সরাসরি অনুমতি দিয়েছিলেন তার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ।
ফাঁস হওয়া অডিওটি সম্পর্কে জানেন এমন একটি সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে, গত ১৮ জুলাই শেখ হাসিনা গণভবন থেকে এই ফোনালাপ করেন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ ১৮ জুলাইয়ের ফাঁস হওয়া রেকর্ডিংয়ের কণ্ঠের সঙ্গে শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বরের মিল শনাক্ত করেছে।
Comments