
ভয়-ভীতি দেখিয়ে জনগণের ভোট ছাড়া নির্বাচন করার অভিযোগে সাবেক তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে রোববার দুপুরে মামলা করেছে বিএনপি। মামলার কয়েক ঘণ্টা পর সন্ধ্যায় ‘মব’ সৃষ্টি করে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার উত্তরার বাসা ঘেরাও করে স্থানীয় কিছু ‘জনতা’। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তাঁকে হেফাজতে নেয় উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ। এর পর নূরুল হুদাকে মিন্টো রোডে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নেওয়ার পর গ্রেপ্তার দেখানো হয় বিএনপির মামলায়।
কে এম নূরুল হুদা প্রধান নির্বাচন কমিশনার থাকাকালে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। অভিযোগ আছে– সেই ভোটের আগের রাতে ভরে রাখা হয় ব্যালট বাক্স। নূরুল হুদা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্দেশ পালন করতেন বলেও অভিযোগ করে আসছে বিএনপি। গতকাল দুপুরে নূরুল হুদাসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দলটি। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক আরও দুই প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও ১০ নির্বাচন কমিশনার, পুলিশের কর্মকর্তাও আসামি। এতে অজ্ঞাত আসামিও রয়েছে। ওই মামলায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়েছে। তারা সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন না করে উল্টো ভয়-ভীতি দেখিয়ে জনগণের ভোট ছাড়াই নির্বাচন করে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
রোববার রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় এ মামলা করেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মো. সালাহ উদ্দিন খান। ওই মামলা করার পর শেরেবাংলা নগর থানার ওসি ইমাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, মামলা হয়েছে। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যেভাবে নূরুল হুদা আটক
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, এক দল লোক ‘মব’ তৈরি করে নূরুল হুদাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। এ সময় ডিম ছুড়ে মারাসহ তাঁকে নানাভাবে হেনস্তা ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। কেউ কেউ ফেসবুক লাইভও করেন। এমন একটি লাইভে দেখা যায়, নূরুল হুদার গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেন এক ব্যক্তি। তাঁর গেঞ্জি ধরে রেখে বক্তব্য দিতে দেখা যায় ওই ব্যক্তিকে। এক ব্যক্তি জুতার মালা থেকে একটি জুতা নিয়ে নুরুল হুদাকে মারধর করেন। এ সময় ওই ব্যক্তির পাশে পুলিশের পোশাক পরা একজনকে দেখা গেছে। পরে পুলিশ জুতার মালাটি খুলে নিয়ে সাবেক সিইসিকে হেফাজতে নেয়। ওই সময় বাসার দরজার সামনে স্থানীয় এক স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতার নাম নিয়ে স্লোগান দেওয়া হয়। আরেকটি ভিডিওতে নূরুল হুদাকে ঘিরে ধরে ‘স্বেচ্ছাসেবক উত্তর’-এর নামে স্লোগান দিতে শোনা যায় কথিত জনতাকে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, উত্তরা ৫ নম্বর সেক্টরের ১/এ নম্বর সড়কের ২৯ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায় পরিবার নিয়ে থাকেন নূরুল হুদা। গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে এক দল লোক ওই বাড়ির নিচে জড়ো হয়ে ‘মব’ সৃষ্টি করে। এক পর্যায়ে নূরুল হুদার বাসায় ঢুকে লুঙ্গি পরা অবস্থায় তাঁকে ঘেরাও করা হয়।
ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার মহিদুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘কিছু লোক সাবেক সিইসির বাসা ঘিরে রেখেছে– এমন খবর পেয়ে পুলিশ পাঠানো হয়। জনতা তাঁকে আটক করে রেখেছিল। নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁকে হেফাজতে নিয়ে ডিবি কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। শেরেবাংলা নগর থানায় করা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হবে।’
ডিসি আরও বলেন, ‘নূরুল হুদার গলায় জুতা পরানো ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই।’
নূরুল হুদাকে লাঞ্ছিত করার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘কারা এটা করেছে জানি না। তবে এসব নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমেই দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার পুরোটা ধ্বংস হয়েছে বিগত দিনে।’
এদিকে ‘মব’ সৃষ্টি করে উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টিকারী সবাইকে চিহ্নিত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাতে এক বিবৃতিতে সরকার জানায়, নূরুল হুদাকে একটি সুনির্দিষ্ট মামলায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময় ‘মব’সৃষ্ট বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ও অভিযুক্তকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার বিষয়টি সরকারের নজরে এসেছে। সরকার দেশের সব নাগরিকের প্রতি আবারও আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছে।
বিএনপির মামলা
মামলা করার আগে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে মো. সালাহ উদ্দিন খানসহ বিএনপির প্রতিনিধি দল। তারা সিইসির কাছে ওই মামলার অভিযোগপত্র এবং ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের ঘটনায় আরেকটি আলাদা অভিযোগ দেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপি মহাসচিবের পক্ষ থেকে দুটি চিঠি ইসিকে দেওয়া হয়েছে। এতে ১৯ জনের নাম আছে। তালিকায় নামের সংখ্যা আরও বাড়বে। তদন্তের মাধ্যমে অভিযুক্তদের নাম অন্তর্ভুক্ত হবে।
সালাহ উদ্দিন আরও বলেন, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে সংসদ নির্বাচন হয়েছে। ওই নির্বাচনগুলো হয়েছে ফ্যাসিবাদ সরকারের অধীনে। দিনের ভোট রাতে হয়েছে। পরপর তিন নির্বাচনে যারা ভোট কেটে নিয়েছিল, আমরা তাদের বিচার চাই।
ইসি থেকে বের হয়ে বিএনপি নেতারা শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করতে যান। সালাহ উদ্দিন খানের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলেন মিজানুর রহমান, ইকবাল হোসেন, শরিফুল ইসলাম ও নাঈম হাসান। তারা বিএনপি মহাসচিব স্বাক্ষরিত অভিযোগপত্র থানায় জমা দেন।
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের তিন নির্বাচনে ‘গায়েবি মামলা, অপহরণ, গুম, খুন ও নির্যাতন’-এর ভয় দেখিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের ‘গণগ্রেপ্তার’ করে নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা হয়। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে থাকার পরও সংবিধান লঙ্ঘন, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন, সরকারি কর্মচারী হয়েও অবৈধভাবে ভোটে হস্তক্ষেপ, ভয়ভীতি দেখিয়ে ভোটের কাজ সম্পন্ন করা ও জনগণের ভোট না পেলেও সংসদ সদস্য হিসেবে মিথ্যাভাবে বিজয়ী ঘোষণা করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। ওই ঘটনার সাক্ষী সব ভোটার এবং ভোটারদের মধ্যে যারা ভোট দেওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তারাসহ ভোটকেন্দ্রে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্য। এ ছাড়া কেন্দ্রে অনেক সৎ প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, পুলিশ অফিসারসহ স্থানীয় লোকজনসহ অনেকে ঘটনার সাক্ষী হবেন। এ ছাড়া ব্যালট পেপারে যে সিল ও স্বাক্ষর রয়েছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেই প্রকৃতভাবে তারা ভোট দিয়েছে কিনা, সে বিষয়ে উল্লিখিত ঘটনার রহস্য তদন্তে উদ্ঘাটিত হবে।
এজাহারে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ছাড়াও ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার মো. আবদুল মোবারক, আবু হাফিজ ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) জাবেদ আলী, সাবেক আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকারকে আসামি করা হয়েছে। তাদের বিষয়ে বলা হয়েছে, ওই সব আসামি ও নির্বাচন কমিশন মিলে সংবিধান লঙ্ঘন করে নির্বাচন করার জন্য সব জেলা, উপজেলা ও মহানগর নির্বাচন কর্মকর্তা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্বাচন করার নির্দেশ দিয়েছেন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিএনপি নেতাকর্মীকে গুম, খুন ও অপহরণের মতো ঘটনা ঘটায়।
২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচন আয়োজন করায় ওই সময়ের সিইসি কে এম নূরুল হুদা, তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক জাবেদ পাটোয়ারী, এ কে এম শহীদুল হক, বেনজীর আহমেদ, সাবেক এসবিপ্রধান মনিরুল ইসলামের নাম রয়েছে। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) তৎকালীন মহাপরিচালকদের নাম উল্লেখ না করলেও তাদের ‘অজ্ঞাত’ হিসেবে আসামি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের পক্ষে রাতে ভোট কারচুপির অভিযোগ করা হয়েছে। ওই সময়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়া বাকি সব জেলায় অনিয়ম হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচন আয়োজন করায় সাবেক সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল, তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবিব খান, মো. আলমগীর ও আনিছুর রহমানকে আসামি করা হয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ ওই তিন নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। তারা ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে দেশ শাসন করে যায়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে।
গত বছরের ডিসেম্বরে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আংশিক বাতিল করে রায় দেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরানোর পথ তৈরি হয়। অবাধ ও নিরপেক্ষতা ‘নিশ্চিত করতে না পারায়’ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিন জাতীয় নির্বাচনে ‘জনগণের আস্থা ধ্বংস করা হয়েছে’ বলে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয় ওই রায়ে।
গত ১৬ জুন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এক বৈঠক শেষে সরকারপ্রধানের দপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে হওয়া ‘বিতর্কিত’ তিন জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে জড়িত সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিবদের ভূমিকা তদন্তে অবিলম্বে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
Comments