
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আজ শুক্রবার (১৫ আগস্ট) আলাস্কায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে এক বহুল আলোচিত বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন। এই বৈঠকের প্রধান লক্ষ্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সমাধান নিয়ে আলোচনা। তবে, ২০২৩ সালের মার্চে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) পুতিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও যুক্তরাষ্ট্রে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে না। এর পেছনে রয়েছে আইনি ও কূটনৈতিক কারণ।
আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কার্যকারিতা যুক্তরাষ্ট্রে নেই
যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির সদস্য দেশ নয়। ২০০০ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন আইসিসি প্রতিষ্ঠার জন্য রোম সংবিধিতে স্বাক্ষর করলেও, যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট এটি অনুমোদন করেনি। ২০০২ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ আনুষ্ঠানিকভাবে আইসিসির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ছিন্ন করেন, যুক্তি দিয়ে যে এই আদালত মার্কিন সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করে। ফলে, আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে কার্যকর নয়।
ট্রাম্প প্রশাসন আইসিসির প্রতি আরও কঠোর অবস্থান নিয়েছে। আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্তের জন্য আইসিসির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল ওয়াশিংটন। এই প্রেক্ষাপটে, আলাস্কায় পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠক আইনগতভাবে নিরাপদ বলে বিবেচিত হচ্ছে।
পুতিনের আইনি সুরক্ষা ও আলাস্কার তাৎপর্য
২০২৩ সালে আইসিসি পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করায় তিনি বিশ্বের ১২৫টি আইসিসি সদস্য দেশে গ্রেপ্তারের ঝুঁকিতে রয়েছেন। তবে, যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির এখতিয়ার মানে না, ফলে আলাস্কায় এই বৈঠক পুতিনের জন্য আইনি জটিলতা থেকে মুক্ত। এর আগে ২০২৩ সালের আগস্টে আইসিসি সদস্য দেশ মঙ্গোলিয়ায় পুতিন সফর করলেও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি, যদিও গ্রেপ্তারের আহ্বান জানানো হয়েছিল।
আলাস্কার ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্যও এই বৈঠকের জন্য এটিকে উপযুক্ত করে তুলেছে। ১৮৬৭ সালে রাশিয়া এই ভূখণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করে, যা দুই দেশের জটিল ইতিহাসের প্রতীক। বেরিং প্রণালীর মাধ্যমে রাশিয়ার সঙ্গে এর নৈকট্য এবং জয়েন্ট বেস এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসনের মতো সামরিক ঘাঁটির উপস্থিতি এই বৈঠকের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা নিশ্চিত করে।
ট্রাম্পের কঠোর হুঁশিয়ারি
বৈঠকের আগে ট্রাম্প কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। এয়ার ফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “পুতিন যদি যুদ্ধ বন্ধে রাজি না হন, তাহলে রাশিয়াকে কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে।” তিনি ইউক্রেনকে নিরাপত্তা সহায়তার সম্ভাবনার কথাও উল্লেখ করেন, তবে জোর দেন যে তিনি ইউক্রেনের পক্ষ নিয়ে মধ্যস্থতা করবেন না। বরং, কিয়েভকে নিজেদের ভূখণ্ড বিনিময়ের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানিয়েছেন, এই বৈঠক ছয় থেকে সাত ঘণ্টা চলতে পারে এবং এটি ফলপ্রসূ হবে বলে মস্কো আশা করে।
ইউক্রেনের উদ্বেগ ও ইউরোপীয় চাপ
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এই বৈঠককে উচ্চ ঝুঁকির বলে মনে করছেন। তিনি জানিয়েছেন, ডোনেৎস্ক ও জাপোরিঝিয়ার মতো অঞ্চল আলোচনার কেন্দ্রে থাকতে পারে। ইউরোপীয় নেতারা, যার মধ্যে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মার্জ রয়েছেন, জোর দিয়েছেন যে ইউক্রেনের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো শান্তি চুক্তি গ্রহণযোগ্য হবে না।
ইউক্রেনের সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। কিয়েভের বাসিন্দা ইরিনা কোজিরেভা বিবিসিকে বলেন, “আলাস্কার বৈঠকের মাধ্যমে পুতিন তার যুদ্ধাপরাধের বৈধতা পেয়ে যাচ্ছেন।”
বৈঠকের সম্ভাব্য প্রভাব
এই বৈঠক শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কই নয়, বৈশ্বিক রাজনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। ইউক্রেন যুদ্ধ, আর্কটিক সহযোগিতা, এবং সম্ভাব্য বাণিজ্য চুক্তি আলোচনার কেন্দ্রে থাকতে পারে। ট্রাম্পের দাবি, তিনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করতে পারেন, যদিও ইউক্রেন ও তার মিত্ররা ভূখণ্ড বিনিময়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।
আলাস্কার এই বৈঠক আন্তর্জাতিক কূটনীতির এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে, তবে এর ফলাফল এখনো অনিশ্চিত।
সূত্র: বিবিসি, এএফপি, দ্য গার্ডিয়ান
Comments