হাকালুকি হাওরে বিলুপ্তির পথে দেশীয় প্রজাতির ‘রাণী মাছ’

দেশীয় সুস্বাদু মাছ ‘রাণী মাছ’ বা Botia dario এখন আর আগের মতো দেখা যায় না হাকালুকি হাওর ও আশপাশের জলাশয়ে। জেলেদের জালে এ মাছ এখন ধরা পড়ে খুবই কম। এক সময় আষাঢ় থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত প্রচুর পরিমাণে ধরা পড়লেও বর্তমানে এটি প্রায় বিলুপ্তির পথে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জেলেরা ও সংশ্লিষ্টরা।
জুড়ী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান খান জানান, হাকালুকি হাওরসহ সিলেট অঞ্চলের জলাশয় থেকে অন্তত ২৩টি দেশীয় মাছের প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। রানী মাছও তার মধ্যে অন্যতম। মাছটি এক সময় অত্যন্ত সুস্বাদু ও জনপ্রিয় ছিল, যার জন্য স্থানীয় বাজারে এর চাহিদাও ছিল বেশি।
বড়লেখা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মিসবাহ উদ্দিন আফজাল বলেন, সিলেটের কিছু কিছু হাওরে মাঝে-মধ্যে 'রাণী মাছ' দেখা গেলেও বাস্তবতায় এটি প্রায় বিলুপ্ত। শুকনো মৌসুমে হাকালুকি হাওরে বিলগুলোর পানি সম্পূর্ণ সেচে মাছ ধরা হয় বলে মাছের আবাসস্থল ধ্বংস হয়। রাণী মাছ বিলুপ্তির এটিই প্রধান কারণ হিসেবে আমি মনে করি।
তিনি বলেন, মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে যদি 'রাণী মাছের' পোনা উৎপাদন ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে সম্পূর্ণ বিলুপ্তির হাত থেকে এই প্রজাতিকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
স্থানীয় জেলেরা বলছেন, মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে এই মাছের সংরক্ষণে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে তারা আশঙ্কা করছেন, আগামীতে হয়তো সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যাবে এই মাছ।
রাণী মাছের বৈজ্ঞানিক নাম Botia dario, যা 'বাঙালি লোচ' নামেও পরিচিত। এটি একটি রঙিন ও মিঠা পানির মাছ। স্থানীয়দের কাছে এটি ‘বউ মাছ’ নামেও পরিচিত। এই মাছ সাধারণত দুই–তিন মাসে একবার প্রজনন করে এবং একটি স্ত্রী মাছ প্রতি গ্রামে ৮০০–৯০০টি ডিম ছাড়ে। পূর্ণবয়স্ক মাছের গড় ওজন ৮–১০ গ্রাম এবং দৈর্ঘ্য প্রায় ১২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
২০১৭ সালে মৎস্য বিভাগের কিছু এলাকায় সংরক্ষণ কার্যক্রম চালুর পর এই মাছ কিছুটা ফিরে এলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কারণ, সংরক্ষণ উদ্যোগ ছিল সীমিত এবং দেশীয় প্রজাতির প্রতি তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ জলাভূমি হাকালুকি হাওরকে "Ecologically Critical Area" হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এক সময় এই হাওরে ১০৭ থেকে ১৩০ প্রজাতির দেশীয় মাছ পাওয়া যেত, কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় এই সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র ৬৩–৭৫ প্রজাতিতে। এর অন্যতম কারণ অবৈধভাবে মাছ ধরা, বিশেষ ফাঁদ ও নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অতিরিক্ত জল উত্তোলন।
বিশেষজ্ঞ ও জেলেরা বলছেন, এখনই পদক্ষেপ না নিলে রানী মাছের বিলুপ্তি ঠেকানো কঠিন হবে। সম্ভাব্য করণীয় হলো, নির্দিষ্ট প্রজনন মৌসুমে অভয়াশ্রম ঘোষণা ও বাস্তবায়ন। অবৈধ ফাঁদ ও নিষিদ্ধ জাল বন্ধে নিয়মিত অভিযান। স্থানীয় জেলেদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রজনন মৌসুমে সংরক্ষণের সচেতনতা বাড়ানো এবং প্রজাতিভিত্তিক গবেষণা ও গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি করা।
রাণী মাছ শুধু একটি প্রজাতি নয়, এটি হাওরের জীববৈচিত্র্য ও স্থানীয় অর্থনীতির অংশ। এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে আগামী প্রজন্ম এই মাছের নাম শুধু বইয়ে পড়বে। হাওরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জেলেদের জীবনমান রক্ষায় এ মাছের সংরক্ষণ এখন সময়ের দাবি। বিলুপ্তির মুখ থেকে দেশীয় এই ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে দরকার সরকারি উদ্যোগ ও স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ।
Comments