
বৃষ্টিতে দেশের নগরের বিভিন্ন রাস্তা ও এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে সমুদ্রসৈকতে রূপ নেয়- জলাবদ্ধতা যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের নগর জীবনে জলাবদ্ধতা একটি চিরাচরিত সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুম এলেই রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের প্রধান শহরগুলোয় রাস্তাঘাট, অলিগলি এমনকি আবাসিক এলাকাও জলমগ্ন হয়ে পড়ে।
প্রতিবারই এই সমস্যার পুনরাবৃত্তি ঘটলেও কার্যকর কোনো স্থায়ী সমাধান আজও দৃশ্যমান নয়। এই জলাবদ্ধতা কেবল নাগরিক ভোগান্তি নয়, বরং এটি জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং অর্থনীতির ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। মশাবাহিত রোগ যেমন ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া বেড়ে যায়, যানজট সৃষ্টি হয় এবং কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়া ব্যাহত হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা আসে।
প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা ও জনদুর্ভোগ একটি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কেন এ জলাবদ্ধতা? কেন এ জনদুর্ভোগ? এর দায়-দায়িত্ব কার? দেশের শহরগুলোতে জলাবদ্ধতার কারণগুলো একদিনে সৃষ্টি হয়নি। অপরিকল্পিত নগরায়ণের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো ঢাকা শহর। বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের খালগুলো দখল করে বাড়ি, মার্কেট, রাস্তা নির্মাণ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য থাকা নিম্নাঞ্চলগুলো ভরাট করে আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলা, পুকুর, জলাশয়, উন্মুক্ত স্থান ভরাট করে শহরকে কংক্রিটের আবরণে ঢেকে ফেলা, দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, আর সেইসঙ্গে ঢাকা শহরের রাস্তায়, ড্রেনে ও খালে যত্রতত্র ময়লা ফেলায় অভ্যস্ত ঢাকাবাসী।
একটি নগরী জলাবদ্ধ হওয়ার সব কারণই এখানে বিদ্যমান। বৃষ্টির পানি ও ময়লা পানি পরিবহনের জন্য ঢাকা শহরের মাটির নিচ দিয়ে যে ড্রেনেজ লাইনগুলো রয়েছে সেগুলোর মাধ্যমে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন হয়ে শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত খালগুলোয় গিয়ে পড়ার কথা। খালগুলোর মাধ্যমে সেই পানি নদীতে নিষ্কাশন হওয়ার কথা। বছরের পর বছর ধরে খালের জায়গা দখল করে বাড়ি, মার্কেট, রাস্তাসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করায় বেশ কয়েকটি খাল অস্তিত্ব হারিয়েছে, বাকিগুলো সরু নালায় পরিণত হয়েছে।
তার ওপর নগরবাসীর ফেলা ময়লা, আবর্জনা, পলিথিন, রাস্তার ওপর নির্মাণ সামগ্রী রাখা ইত্যাদি কারণে নগরের ড্রেন ও খালগুলো আবর্জনার স্তূপে পরিণত হয়েছে। বৃষ্টির পানি ড্রেনের ওপরের ছিদ্রযুক্ত ঢাকনার মাধ্যমে সড়কের নিচে পানি নিষ্কাশনের ড্রেনে যায়। বিভিন্ন সড়ক ও ফুটপাত সংস্কারকাজের সময় বহু ঢাকনার মুখ বন্ধ করে ফেলে। সেইসঙ্গে পলিথিন, চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিকের বোতলসহ নানা বর্জ্য এবং বালি জমেও অনেক পানি নিষ্কাশন ঢাকনার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সড়কের নিচে থাকা ড্রেনে বৃষ্টির পানি যেতে পারে না।
গত জুলাইয়ে ঢাকার খালগুলো দখলমুক্ত ও সংস্কার নিয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে সেই কার্যক্রম বেশি দূর এগোয়নি। প্রতিবেদনের সাক্ষাৎকারে দুই মেয়র মহোদয় বলেছেন মহানগর জরিপের মাধ্যমে খাল দখলদারিদের সরকারিভাবে দখলকৃত জমির সনদ দেয়া হয়েছে এবং এসব খাল দখলমুক্ত করা আইনগতভাবে অনেক চ্যালেঞ্জিং।
ঢাকার জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণগুলো হলো ময়লা-আবর্জনা জমে ড্রেন ও বক্স কালভার্টগুলো সক্ষমতা অনুযায়ী পানি প্রবাহ করতে না পারা, খালগুলো দখল হয়ে সরু নালায় পরিণত হওয়া ও খালগুলো ময়লা-আবর্জনার স্তূপে পরিণত হওয়ায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে খুবই ধীরগতি, অপরিকল্পিত নগরায়ণে নিচু জলাভূমিগুলো ভরাট করে আবাসিক এলাকা তৈরি, নগরের ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহে দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও জনগণের অসচেতনতা।
এই সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি ও সমন্বিত পরিকল্পনা। যথাযথ ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, খাল-নদী দখলমুক্ত করে পানি প্রবাহ নিশ্চিতকরণ এবং নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি, আবর্জনা ব্যবস্থাপনা আধুনিকীকরণ এবং কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে। জলাবদ্ধতা কোনো মৌসুমি দুর্ভোগ নয়- এটি একটি কাঠামোগত সমস্যা, যার স্থায়ী সমাধান সময়ের দাবি। ঢাকা শহরসহ দেশের প্রধান শহরগুলোর জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকার যথাযথ উদ্যোগ নেবে- এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
Comments