
দেশে বিচারবহির্ভূত হামলা ও মব সন্ত্রাসের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ায় জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে এ ধরনের ঘটনা বেড়েছে। মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, রাজনীতিক, সাধারণ মানুষসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বিকার থাকছে, এমনকি হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার পরিবর্তে আক্রান্ত ব্যক্তিদেরই আটক ও মামলার মুখোমুখি করা হচ্ছে।
উল্লেখযোগ্য ঘটনা
গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোবাইল চুরির অভিযোগে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক ভবঘুরেকে পিটিয়ে হত্যা করেন শিক্ষার্থীরা। একই দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামিম আহমেদ মোল্লাকে হত্যা করা হয়। ২২ ডিসেম্বর কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই কানুকে জুতার মালা পরিয়ে মারধর করা হয়। ২৯ এপ্রিল ঢাকায় অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে পুলিশে সোপর্দ করা হয় এবং তার নামে হত্যা মামলা দেওয়া হয়। ২২ জুন সাবেক সিইসি নুরুল হুদাকে জুতার মালা পরিয়ে মারধর করা হয়।
সাম্প্রতিক ঘটনা
১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিতে যাওয়া রিকশাচালক আজিজুর রহমানকে মারধর করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। পরদিন তার নামে হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের হয়, যা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। ২৯ আগস্ট ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির একটি বৈঠকে সাবেক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জনকে লাঞ্ছিত করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করা হয়।
আদালতে সাংবাদিকের উপর হামলা
বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) বিকেলে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান পান্নার জামিন শুনানির সময় সময় টিভির সাংবাদিক আসিফ মোহাম্মদ সিয়াম ও বাংলা আউটলুকের মোক্তাদির রশীদের উপর হামলা করেন আইনজীবী মহিউদ্দিন মাহি ও তার সহযোগীরা। সিয়ামকে কিল, ঘুষি ও লাথি মেরে রক্তাক্ত করা হয়। বিচারক ঘটনার সময় খাসকামরায় চলে যান। সাংবাদিক সিয়াম বলেন, “আদালতের উপস্থিতিতে আমার উপর হামলা হয়েছে।” মোক্তাদির রশীদ জানান, তিনি পান্নাকে নির্যাতন প্রশ্ন করায় আইনজীবী মাহি ক্ষিপ্ত হয়ে গালাগাল ও হামলার চেষ্টা করেন।
বিশ্লেষকদের উদ্বেগ
রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বিচারবহির্ভূত আচরণ বন্ধে জরুরি পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন। বাসদের সীমা দত্ত বলেন, “অন্যায়ের পক্ষে সাফাই গাওয়ার সুযোগ নেই। আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ প্রয়োজন।” মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, “সরকার কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা দূরবর্তী।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা নিত্রা বলেন, ‘বিচারবহির্ভূতকাণ্ড দুটি কারণে হয়। একটি হলো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, আরেকটি হচ্ছে বিচার না হওয়ার কারণে। অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে ৫ আগস্টের পর এ ধরনের কর্মকাণ্ড বেড়েছে।’
তিনি মনে করেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, অপরাধীকে আইনের হাতে সোপর্দ ও সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে এমন প্রবণতার প্রতিকার করা সম্ভব।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিবাদ করার অধিকার সবারই রয়েছে। তবে কোনও সংগঠিত শক্তি যদি আইন হাতে তুলে নেয়, তাতে এর কার্যকারিতা আর থাকে না। এ ধরনের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। কারণ আমরা তো আইন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই লড়াই করেছি। তাই বিষয়টি সরকারকেই দেখতে হবে।’
আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, ‘বিচারবহির্ভূতআচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। এক্ষেত্রে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকেই নিজেদের কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করার তাগিদ দেন তিনি।
Comments