
রাজধানীর মগবাজারের একটি আবাসিক হোটেলে প্রবাসী মনির হোসেন, তাঁর স্ত্রী নাসরিন আক্তার স্বপ্না ও ছেলে নাঈম হোসেনের রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে নতুন মোড় নিয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে বিষক্রিয়ার লক্ষণ থাকলেও, মনিরের হোটেলের বাইরে কাটানো শেষ এক ঘণ্টা এবং ফোন কলগুলো এখন পুলিশের সন্দেহের কেন্দ্রে। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা খতিয়ে দেখছেন, মনির ওই এক ঘণ্টা কার সঙ্গে ছিলেন এবং হোটেল ফিরে আসা খাবারগুলো তিনি নিজে কিনেছিলেন নাকি কেউ দিয়েছিলেন।
এই ট্র্যাজেডির তদন্ত এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপকমিশনার মাসুদ আলম গণমাধ্যমেকে বলেন, আদ্-দ্বীন হাসপাতালে দু'জনকে মৃত অবস্থায় নেওয়া হয়েছিল এবং আইসিইউতে নেওয়ার পর মনির হোসেন মারা যান।
তিনি জানান, প্রাথমিকভাবে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে বলে মনে হলেও, এটি খাবারের সঙ্গে ছিল নাকি কেউ মিশিয়ে দিয়েছে, তা তদন্ত করা হচ্ছে। রেস্তোরাঁ ও আবাসিক হোটেলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
পুলিশের তদন্তে আরও উঠে এসেছে যে, শনিবার রাত ১২টা পর্যন্ত মনিরের সঙ্গে ফোনে একাধিক ব্যক্তির কথা হয়। এই তালিকায় তাঁর স্বজনরাও আছেন। পরিবহন ব্যবসা এবং বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক মনির হোসেনের বাস বা অন্য কোনো সম্পদ নিয়ে কারও সঙ্গে ঝামেলা ছিল কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
মনির নব্বইয়ের দশকে শ্রমিক ভিসায় সৌদি আরবে গিয়ে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করে বিপুল অর্থ উপার্জন করেন। সেই অর্থ দিয়ে তিনি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ ও ঢাকার কেরানীগঞ্জে সম্পদ গড়েছেন। রামগঞ্জ-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে তাঁর মালিকানায় পাঁচটি যাত্রীবাহী বাস রয়েছে। কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদে ২০১২-১৩ সালে তিনতলা ও পাঁচতলা দুটি বাড়ি কেনেন, যেখান থেকে প্রতি মাসে প্রায় দেড় লাখ টাকা ভাড়া আসে। এই বাড়িগুলো দেখভাল করেন তাঁর দূর সম্পর্কের চাচা রফিকুল ইসলাম, যিনি এক কোটি টাকা মনিরের ব্যাংক হিসাবে বিদেশ থেকে পেয়েছিলেন। মনির, স্বপ্না এবং রফিকুল – এই তিনজনের কাছেই মনিরের সব সম্পদের হিসাব ছিল।
শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলে নাঈমের চিকিৎসা করাতে মনির ও স্ত্রী স্বপ্না শনিবার গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় আসেন। সেদিন চিকিৎসকের দেখা না পাওয়ায় তারা মগবাজার মোড়-সংলগ্ন সুইট স্লিপ আবাসিক হোটেলে ওঠেন। মনিরের ঘনিষ্ঠজন ও বাড়ি দেখভালের দায়িত্বে থাকা রফিকুল রাত ৮টা পর্যন্ত হোটেলে অবস্থান করেন এবং তাদের খাবার কিনে দেন। রাত ৮টার পর রফিকুল চলে যান। রাত ১০টায় ফোন পেয়ে মনির বাইরে যান এবং ঘণ্টাখানেক পর পানি ও আবারও খাবার নিয়ে হোটেলে ফেরেন। সেই খাবার খাওয়ার পরই তারা তিনজন অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং বমি করতে শুরু করেন।
পরদিন (রবিবার) সকাল ৬টা ৩৬ মিনিটে মনির রফিকুলকে ফোন করে অসুস্থতার কথা জানিয়ে দ্রুত হোটেলে আসতে বলেন। সাড়ে ৭টায় রফিকুল এসে একটি ফার্মেসির কর্মচারীকে হোটেলে নিয়ে যান। ওই ব্যক্তি ওষুধ দিয়ে চলে যান। অসুস্থতার খবর শুনে রফিকুলের মেয়েও হোটেলে আসেন। আশ্চর্যজনকভাবে, মনির ও রফিকুল হোটেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অসুস্থতার বিষয়টি জানাননি। বেলা ১১টার পর যখন রফিকুল ও তার মেয়ে অসুস্থ স্বপ্নাকে আদ্-দ্বীন হাসপাতালে নিয়ে যান, তখনই হোটেলের কর্মচারীরা বিষয়টি জানতে পারেন। পরে মনির ও নাঈমকেও হাসপাতালে নেওয়া হয়।
পুলিশ আদ্-দ্বীন হাসপাতাল থেকে রোববার রাতে তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়। সোমবার লাশের ময়নাতদন্ত করা হয় এবং রাতে মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান স্বজনরা।
সোমবার রাতে রমনা থানার এক কর্মকর্তা জানান, এখনও মামলা হয়নি, তবে প্রক্রিয়াধীন। রোববার রফিকুল, তাঁর মেয়ে ও মেয়ের স্বামীকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রফিকুলকে থানায় রেখে অপর দু'জনকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মনিরের চাচাতো ভাই জাকির হোসেন জানান, মনির প্রায় ৩০ বছর সৌদিপ্রবাসী ছিলেন এবং তাঁর তিন ভাইও প্রবাসী। বড় ভাই নুরুল আমিন সোমবার সন্ধ্যায় ইতালি থেকে দেশে ফিরেছেন।
Comments