
বাংলাদেশের ‘সোনালি আঁশ’ খ্যাত পাটের পাশাপাশি এখন পাটকাঠির চাহিদা ও দাম ক্রমশ বেড়ে চলেছে। চুয়াডাঙ্গার পাটচাষিরা পাটকাঠির বহুমুখী ব্যবহারের কারণে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। একসময় শুধু জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত পাটকাঠি এখন পার্টিকেল বোর্ড তৈরি, কলকারখানার কাঁচামাল এবং বিভিন্ন সৌখিন পাটজাত পণ্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
সরেজমিনে চুয়াডাঙ্গা সদরের মাথাভাঙা নদী, দামুড়হুদার রাইসার বিল, পদ্ম বিল, দলকালক্ষীপুরের বিল, আলমডাঙ্গার তাসসারের বিল এবং জীবননগর উপজেলার ভৈরব নদীসহ বিভিন্ন খাল-বিল অঞ্চলে দেখা গেছে, রাস্তার ধারে বাঁশের আঁড়ায় পাটকাঠি শুকানোর কাজে ব্যস্ত চাষিরা। অনেকে পাটকাঠি আঁটি বেঁধে শুকাচ্ছেন। স্থানীয় গৃহিণী ও শ্রমিকরা পাটের আঁশ ছাড়ানোর কাজে সহায়তা করছেন এবং বিনিময়ে টাকার পরিবর্তে পাটকাঠি নিচ্ছেন।
চুয়াডাঙ্গা সদরের গড়াইটুপি, বেগমপুর, গয়েশপুর, হরিয়ান নগর, বেনিপুর, সদরপাড়াসহ বিভিন্ন গ্রামে শত শত নারী পাট জাগ থেকে আঁশ ছাড়াচ্ছেন। দিনশেষে তারা পাটকাঠি মজুরি হিসেবে নিয়ে ভ্যানে করে বাড়িতে ফিরছেন।
সদরপাড়ার বাসিন্দা জবেদা খাতুন বলেন, “বাড়িতে জ্বালানির সংকট থাকায় পাট বাছতে এসেছি। বিনিময়ে পাটকাঠি সংগ্রহ করছি, যা জ্বালানিসহ নানা কাজে ব্যবহার হয়।”
একই গ্রামের পান্না খাতুন জানান, “পাটকাঠি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। এটি জ্বালানি, ঘরের বেড়া ও বিভিন্ন গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত হয়।”
সদরপাড়ার পাটচাষি শহিদুল ইসলাম জানান, “আমি পাঁচটি জায়গায় পাট জাগ দিয়েছি। প্রতিটি জায়গায় অনেক নারী পাটের আঁশ ছাড়াচ্ছেন, আর বিনিময়ে তারা পাটকাঠি নিচ্ছেন। এতে আমার পাট চাষের খরচ অনেকটাই উঠে আসছে।”
মনোহরপুর গ্রামের চাষি রশিদ মিয়া বলেন, “পাট চাষের খরচ কমাতে আমরা আঁশ ছাড়ানোর বিনিময়ে টাকার পরিবর্তে পাটকাঠি দিচ্ছি। এতে কৃষক ও শ্রমিক উভয়েই লাভবান হচ্ছেন।”
এদিকে, জীবননগর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ব্যবসায়ীরা চাষিদের কাছ থেকে প্রতি আঁটি ৫০-৬০ টাকায় পাটকাঠি কিনে শহরে ১০০-১৫০ টাকায় বিক্রি করছেন। ব্যবসায়ী ছমির আলী বলেন, “এখন পাটকাঠি বিক্রির মৌসুম। আমরা প্রতি ভ্যানে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা আয় করছি।”
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাসুদুর রহমান জানান, “এ বছর জেলায় ৬ হাজার ৭৪০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ১ হাজার ২৩৫ হেক্টর বেশি। হেক্টরপ্রতি গড়ে ১৫ বেল পাট উৎপাদিত হয়েছে। পাটের পাশাপাশি পাটকাঠির চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় চাষিরা ভালো দাম পাচ্ছেন। পাটের পাতা জমির উর্বরতা বাড়ায়, আর পাটকাঠি চাষিদের অতিরিক্ত আয়ের উৎস হচ্ছে।”
গবেষক ইন্দ্রনীল বিশ্বাস বলেন, “পাট এমন একটি কৃষিপণ্য, যার কোনো অংশই অব্যবহৃত থাকে না। পাটকাঠির চাহিদা ও ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে এটি চাষিদের বিনিয়োগ উঠিয়ে অতিরিক্ত আয়ের উৎস হতে পারে।”
জীবননগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, “পাট একটি অর্থকরী ফসল। পাটকাঠি চাষিদের আর্থিক সমর্থন দিচ্ছে এবং নানা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে পাট জাগ দেওয়ার সময় আঁশ ও পাটকাঠির মান বজায় রাখা জরুরি।”
Comments