Image description

ময়মনসিংহ নগরীর হরিকিশোর রায় সড়কে অবস্থিত কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষদের ২০০ বছরের পুরনো বাড়ির অনেকাংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। এই ঘটনায় জেলার শিশু একাডেমি সমালোচনার মুখে পড়েছে।

জানা গেছে, সম্প্রতি জেলার শিশু একাডেমি সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িটি ভাঙার কাজ শুরু করে। এটি একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এই ভাঙার কাজ নিয়ে সংস্কৃতিপ্রেমী ও স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে এই ঐতিহ্যবাহী বাড়িটি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন।

জরাজীর্ণ বাড়িটি ভেঙ্গে নতুন ভবন করার উদ্যোগের অংশ হিসেবে একাডেমি এমন পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন এটির কর্মকর্তারা। তাদের দাবি, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সব প্রক্রিয়া মেনে স্থাপনাটি ভাঙা হচ্ছে।

তবে ঐতিহাসিক এমন একটি বাড়ি ভাঙার কাজে হাত দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কর্মকর্তারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে নিন্দা ও ক্ষোভ দেখিয়েছেন অনেকে। পাশাপাশি সাহিত্যিকসহ অনেকে এমন কাজের সমালোচনা করেছেন অনেকে।

মঙ্গলবার নগরীর হরিকিশোর রায় সড়কে অবস্থিত প্রাচীন একতলা বাড়িটি সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, আপাতত ভাঙার কাজ বন্ধ রয়েছে। তবে শিশু একাডেমি হিসেবে ব্যবহৃত বাড়িটির সামনের অংশের অর্ধেক ভাঙার কাজ শেষ হয়েছে। ইটগুলো পড়ে আছে এখানে সেখানে। ভেতরের অংশও অনেকখানি ভেঙে ফেলা হয়েছে। তবে এদিন কোনো শ্রমিককে কাজ করতে দেখা যায়নি।

সংবাদ মাধ্যমে এ ভবন ভাঙার খবর সামনে আসার পর ঐতিহ্যবাহী এ বাড়ি সংস্কার ও পুনর্নিমাণে সহযোগিতা করতে প্রস্তাব দেখিয়েছে ভারত।

ভবনটি ভাঙার বিষয়ে ময়মনসিংহ শিশু একাডেমির জেলা শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা মো. মেহেদী জামান বলেন, ২০১০ সালের পর থেকে বাড়িটি ব্যবহার করা যাচ্ছিল না এবং একাডেমির কার্যক্রম ভাড়াবাড়িতে চালানো হচ্ছিল। ঝুঁকি বিবেচনায় একবার মেরামতের চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি।

“বর্তমানে যে ভাড়া বাড়িতে আছি সেখানে প্রতি মাসে ৪৭ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। এতে সরকারের বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। তাছাড়া ভাড়া বাড়িতে শিশুদের কার্যক্রম চালানো কঠিন।”

তিনি বলেন, স্থাপনা ভাঙার কাজ করছে মেসার্স ময়ূর বিল্ডার্স। ভাঙার কাজ শেষ হলে আপাতত একটি আধাপাকা স্থাপনা হবে এবং পরে পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করা হবে।

ভবনটি রেখে কাজ করা সম্ভব ছিল কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ভবনটি অনেক আগেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। গণপূর্ত অধিদপ্তর এটি নিয়ে আগেই কাজ করে প্রতিবেদন দিয়েছে।

নগরীর বিএনপির কার্যালয়ের পাশে অবস্থিত ভবনটি ভাঙার খবর প্রকাশের পর ময়মনসিংহ সিটি নামে ফেইসবুক গ্রুপে আশিক উজ্জামান নামের একজনের মন্তব্য, “কি আর বলবো, পুরোনো স্থপনা ময়মনসিংহে আর তেমন কিছুই রইলো না। অথচ জমিদারবাড়ির আধিক্যের কারণে ময়মনসিংহ শহরকে বলা হতো জমিদারদের শহর। পুরাতন বিল্ডিংয়ের শহর। আজ সেটা অস্তিত্ব সংকটে। অথচ এই ময়মনসিংহ শহরকে কলকাতার মত রাজকীয় শহর হিসেবে সাজানো যেত।”

মুসরিন আক্তার মিম নামে একজন মন্তব্য করেন, “কেন ভাঙল? এসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন তো প্রিজার্ভ করা উচিত”।

ফাল্গুনি চক্রবর্তী নামের আরেকজন লেখেন, শিশু একাডেমির ক্লাস করতাম এখানে।

লেখক ও সাহিত্যিকরা বলছেন, বাড়িটি শুধু একটি প্রাচীন স্থাপনা নয়, এটি বাংলা শিশুসাহিত্যের পথিকৃৎ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর দত্তক পিতা হরিকিশোর রায়ের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি, যা সুকুমার রায় ও অস্কারজয়ী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের নিবাস ছিল।

একতলা প্রাচীন বাড়িটি শিশু একাডেমি ১৯৮৯ সাল থেকে ব্যবহার করত। ১৯৮৯ সাল থেকে শিশু একাডেমি ভবনটি ব্যবহার শুরু করে। পরিত্যক্ত ও জীর্ণ ভবনটি একাডেমি কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালের পর আর ব্যবহার করেনি। সেই থেকে এটি পড়ে রয়েছে। বাড়িটির সামনে একটি ছোট মাঠ রয়েছে।

হরিকিশোর রায় ছিলেন কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর মসূয়ার জমিদার। তিনি বাংলা শিশুসাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায় ও সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষ।

বাংলাপিডিয়ার তথ্য বলছে, পাঁচ বছর বয়সে উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীকে তার পিতা কালীনাথ রায় ওরফে শ্যামসুন্দর মুন্সীর কাছ থেকে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন ময়মনসিংহের জমিদার হরিকিশোর চৌধুরী। সুপণ্ডিত জমিদার হরিকিশোরের পৃষ্ঠপোষকতায় উপেন্দ্রকিশোরের শিক্ষাজীবন শুরু হয় এবং ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৮৮০ সালে বৃত্তি নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন।

লেখক ও কবি ফয়েজ আহমেদ বলেন, ২০০ বছরের পুরাতন স্থাপনাটির ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব রক্ষা করে ভবন নির্মাণ করা যেত। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও স্থানীয় ইতিহাসবিদরা যেখানে এর সংরক্ষণ চাইছেন, সেখানে শিশু একাডেমি এটি ভেঙে ফেলছে।

“সিদ্ধান্তটি মোটেও ঠিক হয়নি। ইতিহাস ঐতিহ্য এভাবে ধ্বংস করে দিলে এ নগরীর সন্তানেরা কী ধারণা পাবে?”

বাড়িটি ভাঙার বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তা সাবিনা ইয়াসমিন এ সম্পর্কে তথ্য চেয়ে সোমবার জেলা শিশুবিষয়ক কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন করেছেন।

তিনি বলেন, “এটি রায় পরিবারের ঐতিহাসিক বাড়ি এবং সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষের নিবাস ছিল। যদিও এটি এখনও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে তালিকাভুক্ত নয়, তবে এ বছর নতুন জরিপে এটি তালিকাভুক্ত হতে পারে।

“এ বিষয়ে ময়মনসিহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের সাথে দেখা করেছি, তিনি শিশু একাডেমির সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছেন। তবে শতবর্ষী প্রাচীন বাড়িটি ভাঙ্গা মোটেও ঠিক হয়নি তাদের। এই ভবনটি ঠিক করেও নতুন ভবন তৈরি করা যেত।”

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রেজা মো. গোলাম মাসুম প্রধান বলেন, শিশু একাডেমি কীভাবে ভবনটি ভেঙে নতুন ভবনের কাজ করবে তা জানতে তাদেরকে ডাকা হয়েছে। কাগজপত্র দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।