Image description

রক্ত জীবন বাঁচায়—কিন্তু সেই রক্ত যদি হয়ে ওঠে সংক্রমণের উৎস, তখন তা শুধু একজন রোগীর নয়, পুরো সমাজের জন্য ভয়ানক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। মানিকগঞ্জে ঘটে গেছে এমনই এক ঘটনা। অভিযোগ উঠেছে, মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকার 'দেশ সেবা ব্লাড ব্যাংক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার' থেকে সংক্রমিত রক্ত সরবরাহের চেষ্টা করা হয়েছিল এক তরুণী রোগীকে। শেষ মুহূর্তে বিষয়টি ধরা পড়ায় প্রাণে বেঁচে গেছেন রোগী খাদিজা আক্তার (২০)।

গতকাল (৭ জুলাই) মানিকগঞ্জ শহরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি ছিলেন খাদিজা আক্তার। জরুরি অস্ত্রোপচারের জন্য তাঁর রক্তের প্রয়োজন হলে পরিবারের সদস্যরা রক্ত সংগ্রহ করেন দেশ সেবা ব্লাড ব্যাংক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে।

রক্ত প্রদানের আগে সংশ্লিষ্ট নার্স রিপোর্টে অসংগতি দেখতে পান—টেস্টের তারিখ ও স্ক্রিনিং রিপোর্ট ছিল অস্পষ্ট ও সন্দেহজনক। পরে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ নতুন করে রক্ত পরীক্ষা করে দেখে, তাতে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস পজিটিভ ফল এসেছে বলে অভিযোগ।

খাদিজার স্বামী শাহ আলম (২৮) বলেন, টাকার বিনিময়ে রক্ত নিয়েছিলাম—ভাবিনি জীবনের চেয়ে বড় বিপদ নিয়ে আসবে। নার্স না বুঝলে হয়ত স্ত্রীর শরীরে সেই রক্ত দিয়ে দিত!

অভিযোগ আছে, এই প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ‘রক্তদাতা’ ভাড়া করে যাদের স্বাস্থ্যগত কোনো যাচাই-বাছাই করা হয় না। রক্ত সংগ্রহের পর এইচআইভি, হেপাটাইটিস-বি/সি, সিফিলিসের মতো ভয়াবহ সংক্রমণ পরীক্ষাও অনেক ক্ষেত্রে হয় না, অথবা লোক দেখানোভাবে একটি চেকবক্স পূরণ করে ফাইল সিল করা হয়। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই রক্ত দেওয়ার পর রোগীর শরীরে সংক্রমণ বেড়ে যায় বা জটিলতা তৈরি হয়।

সরকার ‌২০০২ সালের সেইভ ব্লাড ট্রান্সফিউশন আইন করেছেন। আইন অনুযায়ী, রক্ত সংগ্রহের সময় এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি ও সি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া—এমন পাঁচটি ট্রান্সফিউজন‑ট্রান্সমিক্টেবল ইনফেকশন (টিটিআই) স্ক্রিনিং আবশ্যিক করা হয়েছে। এছাড়াও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স ও প্রশিক্ষিত জনবল ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান রক্ত সংগ্রহ বা সরবরাহ করতে পারে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১২ সালের মার্চ মাসে দেশ সেবা ব্লাড ব্যাংক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামক বেসরকারি ব্লাড ব্যাংক তিন বছর মেয়াদী অনুমোদন পায়। পরে সেই লাইসেন্সটি দীর্ঘ এক দশকেও নবায়ন করা হয়নি। পাশাপাশি নবায়ন হয়নি ট্রেড লাইসেন্সও। 

এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম রেজা বলেন, আমার কাছে রক্তের জন্য আসলে আমি শুধু ডোনার ম্যানেজ করে দিয়েছি। এর জন্য আমি কোনো টেস্ট করাইনি। ডোনার আমার এখানে আসলে এখান থেকে তারা রক্ত নিয়ে গেছে। আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাড) মানিকগঞ্জ জেলার সভাপতি ডা. বদরুল আলম চৌধুরী বলেন, রক্ত হলো জীবন-কিন্তু এই জীবনদায়ী উপাদান যদি হয়ে ওঠে মুনাফার হাতিয়ার, তবে তা শুধু অনৈতিকই নয়, অপরাধও। সময় এসেছে রক্ত সরবরাহ ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং কঠোর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মানিকগঞ্জের সভাপতি অধ্যাপক ইন্তাজ উদ্দিন বলেন, জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কোনো পদক্ষেপ ইচ্ছাকৃতভাবে নেওয়া হলে তা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। নিয়মবহির্ভূতভাবে রক্ত সরবরাহ করলে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ সকল প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রশাসনের শক্ত অবস্থানে থাকা উচিত। 

এ বিষয়ে সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেন, প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্সের নবায়ন না থাকলে আমরা সে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিব। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে আমরা সংশ্লিষ্ট আইনে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।