মুরাদনগরের ধর্ষণকাণ্ড; পরিকল্পিত ছিল বিবস্ত্র ভিডিও ধারণ ও ছড়ানো

ভুক্তভোগী নারী (২৫) হিন্দু ধর্মাবলম্বীর। প্রায় ১৫ দিন আগে স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি কুমিল্লা মুরাদনগর উপজেলার বাহেরচর গ্রামে বেড়াতে আসেন ভিকটিম। বেশ কিছুদিন আগে ভুক্তভোগীর মা ফজর আলীর কাছে টাকা ধার চান। টাকা ধার দিতেও সম্মত প্রকাশ করেন একই গ্রামের শহিদ মিয়ার বড় ছেলে ফজর আলী। নিজের মোবাইলে টাকা না থাকায় মেয়ের মোবাইল থেকে ফোন দেন ভুক্তভোগীর মা।
সেই সুবাধে ফজর আলী ওই নারীর ফোন নাম্বার পেয়ে বেশ কয়েকবার কথা বলে সুসম্পর্ক তৈরি করেন। কথার রেশ ধরে গত বৃহস্পতিবার রাতে সুযোগ বুঝে ওই নারীর বাড়িতে যান ফজর আলী। সে সময় বাড়ির পাশে পূজা হওয়ায় ভিকটিমকে ঘরে রেখে পরিবারের সদস্যরা সেখানে গিয়েছিলেন। তিনি (ভিকটিম নারী) বাড়িতে একা ছিলেন বলে জানা যায়। রাত আনুমানিক সাড়ে ১১টার দিকে ফজর আলী (৩৮) ঘরের দরজা খুলতে বলেন। এ সময় তিনি দরজা খুলতে অস্বীকৃতিও জানান। এক পর্যায়ে জোরে ধাক্কা দিলে দরজা খুলে যায়। ভেতরে ঢুকে তাকে ধর্ষণ করেন। ঘরে ঢোকার সময় ফজর আলীকে দেখে ফেলেন পাশের বাড়ির এক প্রতিবেশী।
তিনি বিষয়টি জানাজানি করলে এলাকার লোকজন ঘরে ঢুকে মবের সৃষ্টি তৈরি করেন। ঘটনাস্থলেই ফজর আলীকে মারধর করে লোকজন। শারীরিক নির্যাতন, শ্লীলতাহানী সহ অশ্লীল ভিডিও চিত্র ধারন করে এবং পরবর্তীতে উক্ত ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় ভিকটিম বাদী হয়ে কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানায় একটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন এবং পর্নোগ্রাফী নিয়ন্ত্রন আইনে মামলা দায়ের করেন, যার মামলা নং-২০, তারিখ-২৯/০৬/২০২৫ ইং, ধারা-নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী/২০০৩) এর ১০ তৎসহ ২০১২ সালের পর্নোগ্রাফী নিয়ন্ত্রন আইনের ৮(১)/৮(২)/৮(৩)। উক্ত ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ ও অন্যান্য মিডিয়ায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।
মুরাদনগরের আলোচিত এই ঘটনার পর থেকে এর সাথে জড়িত মূল আসামীদের গ্রেফতারের লক্ষ্যে র্যাব-১১,সিপিসি-২ কুমিল্লা গোয়েন্দা নজরদারী চলমান রাখে। গোয়েন্দা নজরদারী, তথ্য প্রযুক্তির সহায়তা ও প্রাপ্ত গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত ০৩/০৭/২০২৫ ইং তারিখে র্যাব-১১, সিপিসি-২ এর আভিযানিক দল কুমিল্লা জেলার বুড়িচং থানাধীন কাবিলা বাজার এলাকা থেকে উক্ত ঘটনায় মব সৃষ্টির অন্যতম পরিকল্পনাকারী মুরাদনগর উপজেলার বাহেরচর গ্রামের শহিদ মিয়ার পুত্র শাহ পরান (২৮) কে গ্রেফতার করে। গ্রেপ্তারকালে আসামীর নিকট হতে একটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
র্যাব জানান, উক্ত ঘটনার পনেরো দিন পূর্বে ভিকটিম তার স্বামীর বাড়ী হতে পিতার বাড়ীতে বেড়াতে আসে। আরও জানা যায় যে, বাহেরচর গ্রামের শহিদের বড় ছেলে ফজর আলী ও ছোট ছেলে শাহ পরান দীর্ঘদিন যাবৎ ভিকটিমকে উত্যক্ত করে আসছিল। ঘটনার দুই মাস পূর্বে তাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে বিরোধের জের ধরে কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এরই প্রেক্ষিতে গ্রাম্য শালিসে জন সম্মুখে বড় ভাই ফজর আলী তার ছোট ভাই শাহ পরানকে চর থাপ্পরও মারে। তৎপরবর্তীতে শাহ পরান তার বড় ভাইয়ের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সুযোগের সন্ধানে থাকে। শালিসের কিছু দিন পর ভিকটিমের মা ফজর আলী নিকট থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা সুদের বিনিময়ে লোন নেন।
ঘটনার দিন ২৬/৬/২০২৫ ইং রাতে ভিকটিমের পিতা-মাতা নিকটবর্তী জনৈক ব্যক্তির বাড়ীতে সনাতন ধর্মালম্বীদের মেলা দেখতে যায়। এই সুযোগে ফজর আলী সুদের টাকা আদায়ের অযুহাতে রাত সাড়ে ১১টায় কৌশলে ভিকটিমের শয়নকক্ষে প্রবেশ করে। একই তারিখে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ভিকটিমের বাড়ীর আশেপাশে অবস্থান করা মব সৃষ্টির মূল হোতা শাহ পরান ও ফজর আলীর পূর্ব শত্রু একই গ্রামের আবুল কালাম সহ অনিক, আরিফ, সুমন, রমজান এবং অজ্ঞাতনামা ৮/১০ জন ব্যক্তি দরজা ভেঙ্গে প্রবেশ করেই ভিকটিমকে শারীরিক নির্যাতন, শ্লীলতাহানী ও অশ্লীল ভিডিও চিত্র ধারন করে এবং পরবর্তীতে উক্ত ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়।
ঘটনার পর মূল হোতা শাহ পরান সহ আবুল কালাম ও অন্যান্য আসামীরা আত্মগোপন করে। পরবর্তীতে র্যাব-১১ তথ্য প্রযুক্তি ও গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আসামী শাহ পরানকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গ্রেফতারকৃত আসামী স্বীকার করে যে, পূর্ব শত্রুতার কারণে তার ভাই ফজর আলীর উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে তার নির্দেশনা মোতাবেক অন্যান্য আসামীদের সহায়তায় ভিকটিম ও ফজর আলীকে নির্যাতন, শ্লীলতাহানী ও অশ্লীল ভিডিও চিত্র ধারন পূর্বক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটায়।
র্যাব-১১, সিপিসি-২ সাংবাদিকদের জানান-মব সৃষ্টির মূল হোতাকে শুক্রবারের মধ্যে আইনানুগ প্রক্রিয়া শেষে মুরাদনগর থানায় হস্তান্তর করা হবে।
Comments